
বহু আগে ন্যাটজিও চ্যানেলের মারফতে প্রথম জেনেছিলাম আংকোর ওয়াটের মন্দির সম্পর্কে। কী বিশাল সেই স্থাপনা! হার মানায় তাজমহলকেও। যখন দেখেছি তখন ঘুরতে যাবার বয়স কিংবা সুযোগ কোনটাই ছিল না। মাশীদের কল্যাণে এবার শেষ পর্যন্ত বেড়িয়ে আসা হল। আংকোর ওয়াট নিয়ে তার উৎসাহ আরো এককাঠি বেশী। ট্রাভেলএজেন্টেকে দিয়ে সে ঝটপট টিকেটভিসা করে ফেলল। আমার ঘাড়ে পড়ল হোটেল আর প্রোগ্রাম ঠিক করার দায়িত্ব।
আংকোর ওয়াটের মন্দিরটি অবস্থিত কম্বোডিয়ার সিয়াম রিপ (Siem Reap) শহরে। সিয়াম রিপে কুয়ালালুমপুর থেকে সরাসরি বিমান যায় বলে যাত্রার ঝক্কি কম, মাত্র দুঘন্টা লাগে যেতে। হোটেল খুঁজতে বসলাম নেটে। Villa Siem Reap নামের একটা হোটেল পছন্দ হয়ে গেল, জনপ্রতি ১৭৫ মার্কিন ডলারে এদের ৪রাত৫দিনের প্যাকেজ টুর এর ব্যবস্থা আছে। সেটাই নিয়ে নিলাম। আইটিনেরারি ঘাটতে গিয়ে জানা গেল, সিয়াম রিপে মন্দির একটা নয়, সংখ্যাটি শতাধিক!! আংকোর ওয়াট ছাড়াও আছে আংকোর টম, বান্তাই শ্রী, তা প্রম, প্রিয়াহ খান এর অসাধারন সব মন্দির!
যাবার আগে আমার ক্যানন ইএফ ১৭-৪০মিমি এফ/৪এল লেন্সের জন্য একটা হয়া প্রো১ সার্কুলার পোলারাইজার ফিল্টার কিনে নিলাম, সাথে ল্যান্ডস্কেল তোলার কায়দাকানুন নিয়ে একটা ব্রিটিশ ম্যাগাজিন। আমি ল্যান্ডস্কেপ একেবারেই কম তুলি। তাই একটু পড়াশোনা করে নেওয়াটা জরুরী ছিল। কী এপারচার ব্যবহার করতে হবে, ফোকাস করতে হবে কোন জায়গায়, পোলারাইজার কিভাবে ব্যবহার করতে হবে, ওয়াইড শটের কম্পোজিশনের ধরন নিয়ে বিমানে বসেই কিছু জিনিস জেনে নেওয়া গেল। বিমানে লাগেজের সীমা ২০কিলো, আর আমার ক্যামেরার ব্যাগের ওজনই ৭কিলোর মতো। লেন্স নিয়েছি সবগুলো (৩৫mm f/১.৪L, ১৩৫mm f/২L, ১০০-৪০০mm f/৪.৫-৫.৬L, ১৭-৪০mm f/৪L), সাথে রিমোট শাটার রিলিজ, রিমোট ফ্ল্যাশ ট্রিগার, স্পিডলাইট, ট্রাইপড, মনোপড, আমব্রেলা কোন কিছুই বাদ রাখিনি!!
সিয়াম রিপের এয়ারপোর্ট ছোট কিন্তু যত্ন করে সাজানো। সবুজ পাসপোর্ট হওয়াতে মিনিট পনেরো লাগলো ছাড়া পেতে। বের হয়েই দেখি টুকটুক নিয়ে অপেক্ষা করছে হোটেলের ড্রাইভার স্না। টুকটুক হল মোটর বাইকের পিছে একটা বগির মতো জিনিস, যেটা একটা বিশাল স্ক্রু দিয়ে বাইকের সাথে আটকানো। কম্বোডিয়ার প্রধান বাহনই হল টুকটুক। হোটেলে গিয়ে মন ভালো হয়ে গেল, খাসা জায়গা, লোকজনও ভালো। তবে একটা ধাক্কা বাকি ছিল। জানা গেল মন্দিরে বেড়াতে গেলে পাস কিনতে হবে, একদিনের জন্য জনপ্রতি ২০ডলার। আমরা থাকব পাঁচদিন, তার জন্য লাগবে উইকলি পাস, যার দাম ৬০ডলার। খসে গেল ১২০ডলার। বলা প্রয়োজন কম্বোডিয়াতে স্থানীয় মুদ্রার চেয়ে মার্কিন ডলারই বেশী চলে (অত্যাধিতক টুরিজমের ফল)। যারা যাবেন তারা ভালো পরিমান ভাংতি ডলার নিয়ে যাবেন, যদিও ATM মেশিন থেকে ডলার তুলতে পারবেন প্রয়োজনে।
আইটিনেরারিতে প্রথম দিনের প্রথম কাজ ছিল আংকোর ওয়াটের সামনে বসে ওয়াইন আর চীজ খেতে খেতে সূর্যাস্ত উপভোগ করা (লাটসাহেবী কাকে বলে!)। বিকেলের দিকে পাস কিনতে রওনা হলাম আমরা। পাস এখানে পাসপোর্টের মতো। যেকোন মন্দিরে ঢোকার আগে পাস দেখে নেওয়া হয়। পাস না থাকলে কোন খাতির নাই, হারালে কিন্তু হবে আবার। পাসে ওয়েবক্যাম দিয়ে ছবি তুলে সেঁটে দেওয়া হয়, ফলে দুনম্বরি করার উপায় নেই, আর চেক করার সময় লোকজন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। তাই পাস নিয়ে সাবধানে থাকাটা জরুরী।
আংকোর ওয়াটের মন্দির নিয়ে বিশদ তথ্য আছে এখানে। সংক্ষেপে বললে, রাজা ২য় সূর্যবর্মন ১২শ শতাব্দীতে এই মন্দির স্থাপন করেন। তিনি হিন্দু রাজা ছিলেন। এই মন্দিরটি তৈরি হয় দক্ষিনভারতীয় ধাঁচে, খানিকটা মেরু পর্বতের আদলে। ২০৩ একরে জায়গায় ওপরে তৈরি এই মন্দির বিশ্ব ঐতিহ্যের সবচে' গুরুত্বপূর্ণ ও অসাধারন স্থাপত্যকর্মের একটি। রাজা সূর্যবর্মনের পরে রাজা ৭ম জয়বর্মন আংকোর ওয়াট থেকে খানিক দূরে "আংকোর থম" নামের একটি শহর গড়ে তোলেন। "আংকোর থম" এর প্রতি প্রান্তে বুদ্ধের মুখমন্ডল বসানো আছে। প্রত্নতাত্বিকদের ধারনা এই মুখগুলো রাজা জয়বর্মন আর বুদ্ধের মুখের সম্মিলিত চেহারা। নিজেকে ঈশ্বর রাজা হিসাবে তুলে ধরতেই হয়তো এই কীর্তির সূচনা। "আংকোর থম" থেকে বেশ খানিকটা দূরে গেলে জঙ্গলের মাঝে দেখা যাবে "তা প্রম" এর মন্দির। "তা প্রম" এর এই মন্দির গুলো বুনোগাছে ঢেকে গেছে। এই জায়গাটা এতোই বুনো যে হলিউডি ছবি "টুম্ব রাইডার" এর শুটিং করার জন্য একেই লোকেশন হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
টানা তিনদিন মন্দিরে মন্দিরে বেড়াতে গিয়ে আমাদের একপর্যায়ে অবস্থা সঙ্গীন হয়ে গেল। বাধ্য হয়ে দুইজনকে পরপর দুরাত ফুট ম্যাসাজ নিতে হল। যারা ছবি তোলার জন্য যাবেন, তাদের জন্য উপদেশ হল আংকোর ওয়াট, আংকোর থম আর তা প্রমের মন্দিরে বেশী করে সময় দিন, এক সাথে সবগুলো দেখতে গেলে বিপদে পড়বেন। দিনের আলো কবে কোথায় কেমন হবে সেটা আগে থেকে জেনে রাখাটাও জরুরী, না হলে এক্সপোজার নিয়ে ভ্যাজাল হবে!
তৃতীয় দিনে আমাদের গন্তব্য ছিল "কবাল স্পিয়ান" এর জলপ্রপাত। দেড় কিলো পাহাড়ী পথে হাঁটতে গিয়ে দম বেরিয়ে গিয়েছিলো প্রায়। কিন্তু শেষমেষ জলপ্রপাতের গায়ে খোদাইকর্ম দেখে ক্লান্তি ভুলে মহানন্দে ছবি তুলতে ব্যস্ত হলাম দুজনে। জলপ্রপাতের গোড়ায় শিবলিংগ খোদাই করা, যেন পানি এর উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে শুদ্ধ হয়!!
প্যাকেজের শেষদিনে ফ্লুক নামের একটা গ্রামে নিয়ে যাবার কথা ছিল। সমস্যার কারনে আমরা গেলাম "তোনলে স্যাপ" লেক দেখতে। এই লেকটিকে দেখলে এক পর্যায়ে সাগর বলে ভুল হতে পারে। ছবি তুলবার জন্য চমৎকার যায়গা, লেকের দুপাশে ফ্লোটিং ভিলেজের জলজীবি মানুষদের নিয়ে চমৎকার কাজ করা সম্ভব। আমরা সৌভাগ্যবান, চমৎকার একটা সুর্যাস্ত পেয়েছিলাম সেদিন।
এই ফাঁকে খাবার আর পরিবহনের কথা বলে দেই। একটা টুকটুকের দিন প্রতি ভাড়া ১৫ডলার। গাইডের ভাড়া ৩০ডলার। আর খাবার জনপ্রতি ৭-১০ডলার। পাব স্ট্রীটে চমৎকার সব বার আর রেস্তোরা আছে। শখের বসে প্রথমদিন ডিনারে কুমির আর অজগরের বারবিকিউ খেলাম দুজনে। যতোটা জঘন্য মনে হয়, তার ধারে কাছেও না! আমরা হালাল-টালাল নিয়ে ভাবিনা বলে ঝামেলা হয়নি। যাদের হালাল ইসু আছে তাদের কপালে দুঃখ আছে, লার্ড এই দিকটায় বেশ জনপ্রিয় ও বহুল ব্যবহৃত।
সিয়াম রিপে প্রচুর টুরিস্ট আসে, শহরটা টিকেই আছে এদের পয়সাতে। তাই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যস্ত সবাই। আমরা লক্ষ্য করেছি এখানকার মানুষ কিঞ্চিত সাধু প্রকৃতির (শয়তান পল পট বাদে!)। এরা আচরনে বিনয়ী, স্বভাবে শান্ত। ব্যাগ রেখে বহুবার এদিক সেদিক গেছি। কেউ ছুঁয়ে দেখেনি, মালেশিয়া বা সিংগাপুরে এটা ভাবাও যায় না!
যাই হোক, এবার একটা স্লাইড শো দেখা যাক..
Set URL: http://www.flickr.com/photos/harvie-krumpet/sets/72157623065270048/