Wednesday, December 26, 2007

ঢাকার চিঠি - ০৪

ঢাকায় এখন ভালো মিষ্টি মানেই প্রিমিয়াম সুইটস। আলাউদ্দীন আর বনফুলকে এখন সেকেন্ড গ্রেড বলে ধরা হয়। ঈদের আগের দিন টাকা তুলতে গেছি চার নম্বরে (ধানমন্ডি)। পাশেই দেখি প্রিমিয়ামের দোকান। ভাবলাম শ্বশুরবাড়ির জন্য এক প্যাকেট নেই। একটু পরে মনে হল, স্পঞ্জ রসগোল্লা খাওয়া হয়না বহুদিন, সেটাও নিয়ে ফেলি। হঠাৎ চোখ পড়ল শোকেসে সাজিয়ে রাখা ঘি এর বয়ামগুলোর উপর। শেষে কি মনে করে, এক বয়াম ঘি-ও কিনে ফেললাম।

আমি ঢাকায় তিনবেলাই আলুভর্তা আর ভাত খাই। তো ঘি কেনার পর, এখন ধোঁয়াওঠা ভাতে এক চামচ করে ঘি ঢেলে দেই। এর কি স্বাদ, তা ব্যাখ্যার ধৃষ্টতায় গেলাম না। বাঙালীর এই অমৃতের কথা ফরাসীরা জানলে হয়তো ড্রাম ড্রাম ঘি এয়ার ফ্রান্সের খালি কার্গো বিমানে ভরে নিয়ে পালাতো (বিষ্ণুমুর্তি চুরির পর বেহুদা খালি প্লেন নিয়ে কি লাভ)। ঘি এর বয়ামের দিকে হাত বাড়ালে অবশ্য বাবা কেমন ঘোঁৎ করে আওয়াজ করেন। আমি হাসি আর সুমন চৌধুরীর সিগনেচার আউরে যাই,
"ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ (ঋণ করে হলেও ঘি খাবি, যদ্দিন বাঁচবি সুখে বাঁচবি)"

ঈদের পর দিন বোরিং গেল। হাটতে বেরুলাম। পথে প্রকৃতির ডাক পেয়ে কঠিন বিপদে পড়লাম। বাইরে এ জাতীয় সমস্যার ভালো সমাধান হল ম্যাকডোনল্ডসে ঢুকে পড়া। ঈদের ছুটিতে দোকানপাট বন্ধ। ফলে বাঁচতে হলে জীপার খুলে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে পড়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। আমার জায়গায় একটা মেয়ে হলে কি হতো কল্পনা করার চেষ্টা করি! ২৭ নম্বরে ন্যান্দোস (Nando's) খুলেছে নতুন। দাঁতে দাঁত চেপে দৌড় দেই সেদিকে।


ন্যান্ডোজ (ধানমন্ডি ২৭ নম্বর রোড)
ন্যান্ডোজ (ধানমন্ডি ২৭ নম্বর রোড)

নান্দোস আমার পছন্দের জায়গা। ঢাকায় খুলেছে শুনে ভীষন ভালো লেগেছিল। দিলাম অর্ডার করে, কোয়ার্টার চিকেন মিল! খাবার ভালো, কিন্তু দামটা আরও ভালো ৩১০টাকা! মালেশিয়াতেও ঠিক এই দাম। ঢাকার মানুষের পকেট ভারি নাহলে কি করে এমন দাম রাখতে পারে এরা? ভালো লাগলো ওয়েটারদের, সবাই ছাত্র। কেউ পার্ট টাইম, কেউ ফুল টাইম। ভালো ইংরেজী বলে সবাই। কথা হল রমেনের সাথে। জানা গেল একাজে পয়সা আসে ভালোই। তাকে চাকরী পেতে রীতিমতো কয়েকধাপ ইন্টারভিউ নাকি দিতে হয়েছে।

নান্দেসোর ঠিক উল্টো দিকেই এটসেটেরা। আর এটসেটেরার দোতলায় হল দেশের বনেদী কফি শপ, "কফি ওয়ার্ল্ড"। মাসুদ ভাই বলেছিলেন, আমাকে কফিওয়ার্ল্ড আর কজমোতে মানাবে না... কথা ভুল না। নানাবয়সি যুগলের ভীড়ে খানিকটা অস্বস্তিতেই পড়তে হল। তারউপরে বনেদী দোকান, ওয়েটাররা সহজে পাত্তাও দিতে চায় না। দুটো লা'তে খেতে আমার ২৯৯টাকা বের হয়ে গেল।

দেশ যখন এদিকে অনেক এগিয়ে যাচ্ছে তখন স্টার কাবাবে গিয়ে একটু শান্তি লাগলো। তবে পেটপুরে খেতে গিয়ে (২টা খিরি, ১টা শিক, ১টা ঝাল ফ্রাই, ১টা ব্রেন, ১টা স্প্রাইট, ১টা চা, ২টা বাটার নান) লাগলো ৪০১টাকা। কি বুঝলেন?


দেশে এসে ছবি তোলার অনেক শখ ছিল। পরশু গেলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। টিএসসিতে হালকা পাতলা কিছু স্ন্যাপ নিয়ে ঢুকলাম সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। কেমন বিরান হয়েগেছে। সেই সবুজও নেই, সেই পরিচ্ছন্নভাবটাও উধাও। ঘাসওঠা মাঠে শুয়ে আছে বাস্তুহারা মানুষেরা। একটু এগুতেই চোখে পড়ল বিশাল জলাধার, যার পিছনে এক অসমাপ্ত স্থাপনা। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে যখন পৌছালাম তখন পথ আগলে দাড়াল দুই আনসার।
- "এইটা কি ভাই? কি বানায় এইখানে"
- "এইডা স্বাধীনতা ইস্তমভো.."
- "ঢুকা যাবে না?"
- "না । কাজ শ্যাষ হলে খুলে দেওয়া হবি"
- "কবে শুরু হইছে এইটা বানানো?"
- "আট বচ্ছর, এক পাট্টি শুরু করে, আরেক পাট্টি বোন্দো করে.. এখন কাজ বোন্দো আছে.. ভাই এইডা কি ভিডো ক্যামেরা?"

অযত্ন অবহেলায় অর্ধসমাপ্ত স্বাধীনতা স্তম্ভের টেরাকোটা খচিত দেওয়াল
অযত্ন অবহেলায় অর্ধসমাপ্ত স্বাধীনতা স্তম্ভের টেরাকোটা খচিত দেওয়াল

আমি কথা না বলি খালি চোখে একটু দেখার চেষ্টা করি। এখানে নাকি আন্ডারগ্রাউন্ড জাদুঘর হবে। বিশাল স্তম্ভ হবে, চারপাশ ঘিরে থাকবে জলাশয়.. । টেরোকোটা সজ্জিত উচু দেওয়ালে অলসভাবে বসে আছে কয়েকটা চিল। জলায়শের পানিতে কাপর ধুতে ব্যস্ত গৃহহীণ মানুষেরা। আমাদের প্রাণের গৌরবের প্রতীক সেই স্বাধীনতা স্তম্ভকে এমন পটভূমিতে কল্পনা করা কঠিন হয়ে পড়ে। প্রবেশদ্বারের পাশেই আলু চাষ হচ্ছে। স্বাধীনতায় তো আর পেট ভরে না।
স্বাধীনতায় পেট ভরে না, আলুচাষে ভরে (সোহরাওয়াদী উদ্যান, ২৪/১২/০৭)
স্বাধীনতায় পেট ভরে না, আলুচাষে ভরে (সোহরাওয়াদী উদ্যান, ২৪/১২/০৭)

জলপাই এর পাহারা বাঁচিয়ে ছুঁয়ে ফেলা এক চিলতে শিখা চিরন্তনের আঁচ
জলপাই এর পাহারা বাঁচিয়ে ছুঁয়ে ফেলা এক চিলতে শিখা চিরন্তনের আঁচ


হঠাৎ দূরে দেখি এক চিলতে আগুন, শিখা চিরন্তন। ক্যামেরা নিয়ে ছুটে যাই ছবি তুলতে। পথ আটকায় জলপাই ভ্রাতারা। ঢোকা যাবে না, ছবি তোলা যাবে না। তর্কে যাই না, কি দর্কার প্রকাশ্যে চড়থাপ্পর খেয়ে। শিখা চিরন্তন এর চেয়ে আমার "সম্মান" যে এখন অনেক বেশী জরুরী। এই দেশটাকে মাঝে মাঝে ব্যাখ্যা করা বড় কঠিন হয়ে যায়..


"এই লেইন অতিক্রম সর্ব সাধারনের জন্য নিষিদ্ধ" কেন?
"এই লেইন অতিক্রম সর্ব সাধারনের জন্য নিষিদ্ধ" কেন?

আপনিই বরং সুখে আছেন (অপরাজেয় বাংলা)
আপনিই বরং সুখে আছেন (অপরাজেয় বাংলা)

মনে পড়ে, ভাঁপা পিঠা?
মনে পড়ে, ভাঁপা পিঠা?

শহীদ স্মৃতিসৌধ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়শহীদ স্মৃতিসৌধ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ব্রিটিশ কাউন্সিল
ব্রিটিশ কাউন্সিল

ছবি তুলতে তুলতে একসময় হাজির হই শহীদ মিনারে। ছোটবেলায় মামার সাথে ছবি তুলতে আসতাম। দুপুর ১টার পর যখন পুলিশ পাহারা উঠে যেত, তখন দেখতাম ববর্র সব যুবক আর কিশোরেরা বেদীমূল থেকে ফুল ছিনিয়ে নিয়ে কি তান্ডবই না চালাতো। এবার গিয়ে প্রথমেই ধাক্কা খেলাম, মিনারের সমানে কিশোরেরা ব্যস্ত সাইকেল রেসিং নিয়ে। প্রচুর মানুষ বেদীমূলে বসে আড্ডারত, জুতো খুলবার বিষয়টা মাথা মনে হয় আসেই না এদের। অনেক হাটায় ক্লান্ত ছিলাম। তাই সিড়িকোনায় বসলাম। এর পরবর্তী ঘটনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। কোথা থেকে হাজির হতে শুরু করলো নানা রং এর, নানা মাপের সব ছাগল। দেশের পবিত্রতম সৌধের পাদদেশে চতুষ্পদী এই নির্বোধ প্রাণীদের কি অবাধ বিচরন! কি লজ্জা! কি লজ্জা!

সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য যাচ্ছে কাদের দখলে?
সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য যাচ্ছে কাদের দখলে?

দুর্ভাগা প্রজন্ম
দুর্ভাগা প্রজন্ম

ক্ষমতা আর বিত্তের সিড়ি কারা বেয়ে ওঠে আজ
ক্ষমতা আর বিত্তের সিড়ি কারা বেয়ে ওঠে আজ

মাঝে মাঝে বড় অসহায় লাগে, কি অদ্ভুত ভাবেই না আমাদের চেনা শহরটা ধীরে ধীরে অচেনা হয়ে যায়..

Sunday, December 23, 2007

ঢাকার চিঠি - ০৩

পাখি আমার একলা পাখি - চিল (২১/১২/০৭)
পাখি আমার একলা পাখি - চিল (২১/১২/০৭)

বাংলা মা তার প্রবাসী সন্তানদের দেশে স্বাগত জানানোর ঐতিহ্যবাহী রীতি কোনদিন ভুলবে না। আমার ক্ষেত্রে গতবার ব্যতিক্রম হয়নি, এবারো হল না। আসার ২য় দিনে পেট নেমে গেল, ৩য় দিনে সর্দি, ৪র্থ দিনে কাশি আর শ্বাসকষ্ট। আমার জন্মদাত্রী মা অবশ্য এই ভালোবাসাটা টের পান না, বরং যথাসম্ভব বিচলিত হয়ে যন্ত্রনার সৃষ্টি করেন। মালেশিয়া থেকে প্যানাডল অ্যাক্টিফাস্ট পাঠিয়ে ছিলাম, শেষ পর্যন্ত যে সেটা আমারই খেতে হবে ধারনা ছিল না।

ঈদের আগের দিন এক কাজিনের সাথে সাথে গভীর রাত পর্যন্ত গালগল্প হল। ভোর ৫টায় ঘুমাতে গেলাম। বাবার হয়তো ক্ষীন আশা ছেলে অন্তত ঈদের নামাজ পড়তে সঙ্গী হবে, কিন্তু যে ছেলে শেষ কবে ঈদের নামাজে গেছে মনে করতে পারে না তার কাছে এমন আশা না করাই শ্রেয়।

ঈদের দিন, অ্যাজ ইউসুয়াল, বোরিং গেল। লম্বা সময় লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমালাম, ইত্যবসরে শরীর ঐতিহ্য মেনে খারাপ হওয়া শুরু করলো।

কেএল-এ থাকলে ঈদের নাটক দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকি। এবারে ঢাকায় এসে ধাক্কাই খেলাম। BDBangla তে বিজ্ঞাপন ছাড়া দেখে অভ্যেস হয়ে গেছে। কার সহ্য হয় ৩০ মিনিটের নাটকের মাঝে ছয় ছয়টা ৫ মিনিটের কমার্শিয়াল ব্রেক হজম করার! হুমায়ূন ভাই এর নাটকে সবগুলো চ্যানেল সয়লাব। আঙ্কেলের দিন শেষ। উনি বোধহয় SMC এর মতো কম্পিউটারে নাটকের ফর্মূলা ঢুকিয়েছেন, পারমুটেশন কম্বিনেশন করে ছাড়েন কদিন পর পর..

হুআ দাদুর নাটকের চেয়ে মোসা ফারুকীর নাটকগুলো কিঞ্চিৎ উন্নততর, তবে তার কারন নাটকের নাট্যমান নয়, বরং শ্রেফ নির্মানশৈলী। "কবিবলেছেন" দেখে খারাপ লাগেনি। ওয়েল মেড পর্নো দেখেও ভালো লাগে। ফারুকী এ পথে হাটলে কাক্কুর মতো অবস্থা হতে দেরী নাই।

আজকে দুটি অনুষ্ঠান দেখে আমি সোফা থেকে পড়ে গেছি। একটি হল গানের ম্যাগজিন অনুষ্ঠান, দেখাচ্ছিল ইসালামিক টিভিতে। ইসলামী গানে বাদ্যযন্ত্রের ভূমিকা থাকার নিয়ম নেই মনে হয়, এখানেও ব্যতিক্রম নয়। তবে দন্ডায়মান এক ভদ্রলোক (কবি মুজিব মেহেদী দেখলে বিপদ আছে!) যখন পান্দারিক (আরবী পার্কাশন ইন্সট্রুমেন্ট) বাজাতে শুরু করলেন আমি তখন হতবাক, "সাব্বাশ! বাঙ্গালী এখন ড্রামস কিবোর্ড ফেলে পান্দারিক ধরেছে!!"
দি পান্দারিক প্লেয়ার
দি পান্দারিক প্লেয়ার

দ্বিতীয় ঘটনাটা ঘটেছে ঘন্টা তিনেক আগে। চ্যানেল আই-তে হুমায়ূন মামার নাটক হবে, কিন্তু তার পরিচালক কোন এক সময়ের নায়িকা রোজিনা। ভদ্রমহিলা বয়সে আমার খালার সমান। তবে তার দীর্ঘ ক্যারিয়ারে পরিচালনার কোন গল্প আমার জানা ছিল না। নাটকের নাম "সম্পর্ক"। নাটকটা পুরো দেখতে পারলাম না, ভুদাই ঘুড়া আর সমন্বিত বাঘের ডায়েটে যেতে বাধ্য করলেও পারতাম না। কেন? কি দর্কার বলার। আপনাদের জন্য কিছু অংশ YouTube এ তুলে দিয়েছি। বুঝে নিন কি মাল চলে এখন..





এসব কারনে ঈদের নাটক দেখা বন্ধ করেছি। কেএল গিয়ে সময় নিয়ে দেখা যাবে। না হলে তো সিডি/ডিভিডি আছেই।

মইনুদ্দীনকে নিয়ে মেজাজ খারাপ। সে আমাদের পাইলট। ঢাকায় এসেই লক্ষ্য করলাম সে ৪০ উপরে গাড়ি চালায় না, সেই রহস্য যখন সমাধান হল ততক্ষনে আমার প্রায় হাজার পনের টাকা খরচ হয়ে গেছে গাড়িটার জন্য। গাড়িটাকে যখন একটু সাইজে আনলাম, তখন কাল রাতে গ্যারেজের পিলারের সাথে ধাক্কা মেরে ব্যাটা পিছনের একটা দরজা বসিয়ে দিল (কঠিন ইচ্ছাশক্তি আর গাঁজা না খেলে কাজটা করা খুবই কঠিন)। কারো চাকরী খেতে ভালো লাগেনা, এরটা খেতে হবে। কারন এর আগেও একাধিক ঘটনার নায়ক সে। বাসার গাড়িটার অবস্থা বেশ খারাপ। গাড়ি বদলানো জরুরী। এর হাতে নতুন গাড়ি দেওয়া আর পাশের বাসার বিড়ালটাকে ড্রাইভ করতে বলার মধ্যে তেমন ফারাক নাই। পৃথিবীতে কতো নিষ্ঠুর কাজই না করতে হয়..

যাওযার আগে দুটা পলিটিকাল গসিপ শেয়ার করি। যদিও এখন ঢাকার রাস্তায় গসিপ শোনা খুব কঠিন, (জানের মায়া তো সবারই আছে) তারপরেও সিগারেট কেনার সময় কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করি। যেহেতু গসিপ তাই কান না দেওয়াই ভালো।

১. দৈনিক সংগ্রামের ১৯৭১ সালের সকল আর্কাইভড কপি ধ্বংস করতে নেমেছে একটি রাজনৈতিক দল। যে হারে সব পত্রিকায় সংগ্রাম থেকে রেফারেন্স টানা হচ্ছে তাতে কিছু মানুষ বড় গ্যাঞ্জামে পড়ে গেছেন

২. থাক, এইটা কমু না। কইয়া হুদাই ছ্যাচা খাই আর কি!

Friday, December 21, 2007

ঢাকার চিঠি - ০২

ঢাকায় মদ্যপান নিয়ে আমার প্রথম অভিজ্ঞতাটা ভুলবার না। শহরের প্রাণকেন্দ্রে কোন ঝামেলা ছাড়াই যে নিষিদ্ধ এই পানীয় পাওয়া যায় সেটা জেনেছি ইস্টার্ন প্লাজার পাশে র "শ্যালে"তে গিয়ে। সুমন ভাই (পারভেজ সাজ্জাদ) একদিন ধরে নিয়ে গেলেন, ভোদকা খেতে গিয়ে দেখা হল প্রয়াত সঞ্জীব চৌধুরীর সাথে, দলছুট তখন কেবল জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে। হাতে গোনা চার পাঁচবার গেছি শ্যালে আর পিকক-এ। প্রতিবারই একটা ধরা খাবার ভয় কাজ করতো। গতবার যখন ঢাকা এলাম তখন পিয়াল ভাই নিয়ে গেলেন সাকুরাতে (মার্গারিটার প্রতি বাংলার জবাব ভোদকালাইম খেয়ে ব্যাপক আনন্দ পেয়েছিলাম)। এবার উত্তরায় এক বাড়িতে গিয়ে দেখি হোমডিলিভারীতে মদ পাওয়া যাচ্ছে, গৃহকর্তা সেলফোন ডায়াল করলেন, ওপাশ থেকে জানিয়ে দিল কি-আছে,কতো-দর.. গৃহকর্তা খানিক ভেবে অর্ডার দিলেন, মিনিট বিশেকের মাঝেই একটা গিলবি সাহেবের জিনের বোতল পৌছে দিলেন কেউ একজন। এই ঘটনাটা হয়তো আগেও ঘটতো, তবে এবারই যেহেতু প্রথম জানা হল, সে হিসেবে উল্ল্যেখ করাটা মনে হয় ভালো..

কোজি কর্নারে
কোজি কর্নারে


কাল সকালে বাবা বললেন চল, চুল কেটে আসি। আমাদের বাসায় চুল কাটা মানে কদমছাট করা। এর বাইরে একটু কায়দা করে কাটা যে সম্ভব সেটা কারো ধারনায় আসে না। যা হোক, নাপিতের দোকান বাড়ির পাশেই, কোজি কর্নার নাম। কোজি কর্নারে শুধু চুল কাটাই হয়না, চাইলে ফেসিয়ালও করে ফেলা যেতে পারে। প্রচুর কায়দা এদের চুল কাটা নিয়ে, বিদেশী স্টাইল ভালোই নকল করেছে। চুল কাটার এক পর্যায়ে আমার মুখেও ক্রীমটিম মেখে দলাই মালাই শুরু করে দিলেন নাপিত। গালে পুরুষ হাতের দলাই মলাই বিষয়টা ঠিক উপভোগ করা যায় না। আমি ঠোঁট চেপে অপেক্ষা করতে থাকি করে যন্ত্রনার শেষ হবে। সব মিলিয়ে খরচ হল ১৫০টাকা। কেএল-এ সবচে' ফকিরি হালে চুল কাটতেই লাগে ২০০টাকা, মাদাম উইনি লু হাতে কেঁচি ধরলে তো কথাই নাই, ৭০০০টাকা গন উইথ দ্য উইন্ড...

আনিলার অ্যালবাম
আনিলার অ্যালবাম


চুল কেটে গেলাম সিডি কিনতে। জানেমান আনিলার নতুন অ্যালবামটা বের হয়েছে। অর্থহীনের সুমনের সাথে । "গাইবনা" শুনে আমি ফিদা.. এই মেয়েটা গান গাইলে চায়ে চিনি লাগে না.. মুস্কিল হল পুরো অ্যালবামে একটা মাত্র গান ভালো হওয়াটা ঠিক সুলক্ষন না.. এনিওয়ে, আনিলা ইজ আনিলা..

হেলভেশিয়ার ব্রোস্ট
হেলভেশিয়ার ব্রোস্ট


বাড়ি ফিরতে গিয়ে চোখে পড়ল হেলভেশিয়া। একটা সময় মাশীদ আর আমি হরহামেশা আসতাম। ব্রোস্ট খেতে কেমন লাগে সেটা মনে করতে পারলাম না। তাই ঢুকেই পড়লাম। সিঙ্গলে ব্রোস্ট ১০০ থেকে বেড়ে ১৫০টাকায় গেছে। পেপসির দাম আলাদা। আমি দাম দিতে গিয়ে যখন বিশেষ উৎফুল্ল (ক্রেডিট কার্ড অ্যাক্সেপ্ট করেছে!!) তখন পাশের হরিননয়না তরুনীটি পূর্ন সফলতায় আমার পায়ে সাওয়ার ক্রীম ফেলে দিলেন। তারপর কিছুইহয়নি এমনভাব করে গল্প করতে থাকলেন সঙ্গিনীর সাথে। রূপ আর ভব্যতাহীনতা কি সমানুপাতিক হারে বাড়ে?

ব্রোস্ট খেতে গিয়ে আমি বহু চেষ্টা করেও মনে করতে পারলাম না কেন এই জিনিসটাকে গলধকরনের জন্য মুখিয়ে থাকতাম। সময় বড় নিষ্ঠুর, সব কিছু ফিকে করে দেয় সে..

নিউমার্কেট - নীলক্ষেত
নিউমার্কেট - নীলক্ষেত


বিকেলে হাটতে হাটতে গেলাম নিউমার্কেট। সেন্ট ক্যাথরিন ভালো লাগার পিছনের আমার একটা ব্যাখ্যা ছিল। মনে হল ব্যাখ্যাটা ভুল না। নিউমার্কটে সেই একই ভীড়। তবে বুক ভিউ আর সব ডাকসাঁইটে দোকানগুলোর জৌলুস হারিয়ে গেছে। এখন কি বইয়ের কদর নেই?

আমি দুনিয়ার সব দেশেই আমার ট্রেডমার্ক পোষাকে বেড়াতে বের হয়েছি। তাই ঢাকায় খাকি শর্টস আর টি-শার্ট পড়াটা বাদ রাখার মানে হয় না। কিন্তু কে জান্তো সপুত্রক মায়েরা আমার এ বেশ দেখে মুখ টিপে হাসবে.. সিস্টার সাম্ভালকে!..

হাটতে হাটতে এলিফেন্ট রোড, ২৮৮ আর ২৭৮/১। এই দুটো বাড়িতেই আমার শৈশব আর কৈশোর কেটেছে। প্রতিবার দেশে আসলেই এক পলক দেখতে আসি। ২৮৮-র গলিটা আরো ছোট হয়েছে, গেট বসেছে গলির মাথায়। লোকে গাড়ি ঢোকায় কেমন করে কে জানে! এই বাড়িটার প্রাণ থাকলে নিশ্চয়ই খুশি হতো। আমি কথোপকথনটা কল্পনা করি..
-"স্লামালিকুম অপু ভাই (ভাই শব্দটা নিয়ে সংশয় আছে, বাড়ির বয়স আমার চেয়ে বেশী, তার কি ভাই ডাকা মানায়?)
- "আররে ২৮৮, কি খবর? গায়ে এতো শ্যাওলা কেন? হক সাহেবের কি সমস্যা?
- "এই তো, আছি ভালোই। স্যার ভালো নাই, ছোটআপা মরার পর থেকে শরীর খুব খারাপ"


২৮৮ এলিফেন্ট রোড
২৮৮ এলিফেন্ট রোড

অজান্তে জলি আপার প্রসঙ্গটা চলে আসে। আমি বিশেষ অস্বস্তি নিয়ে প্রসঙ্গান্তর করতে চেষ্টা করি


২৭৮ এলিফেন্ট রোড
২৭৮ এলিফেন্ট রোড


২৭৮ এর নতুন নাম হয়েছে, চন্দ্রমল্লিকা। ২৭৮ এর পাশে মেজর সাহেবের বাড়িটা খুঁজে পাইনা। তার বদলে টিনার বেড়া, গায়ে লেখা চাঁদনী ডমইনো। আমরা চলে যাবার অনেক দিন পর চাঁদনী আপাও মারা যান ক্যান্সারে। মেজর সাহেবের বাসার গ্যারেজ ছিল আমারদের প্রিয় খেলার যায়গা। হুমম.. আমি জোরে হাটি, কি দরকার স্মৃতি ঘেঁটে কষ্ট তুলে আনার ।

রাতে লুনা আপির শোধবোধ দাওয়াত ছিল। কজমো লাউঞ্জে খাওয়াবেন। মাসুদ ভাই শুনেই বলেছিলেন ওখানে আমাকে মানায় না। সাতমসজিদের এই লাউঞ্জ ঢাকার তুলনা অনেক এগিয়ে। প্রতি বৃহস্পতিবার গানাবাজনাও হয়। পয়সা দিলে মিউজিক বা ভিডিও ছেড়ে দেবে। মেনুর কোনায় লেখা PDA নিষিদ্ধ। পরে জানলাম PDA মানে Public Demonstration of Affection. আগে নাকি স্মোকিং রুমে ভালোই আদর সোহাগ চলতো। তাই এই আইন। কজমোর খাবার আহামরি না, যতোটা এখানে হাজিরা দেওয়াটা। কফি ওয়ার্ল্ডেও যেতে হবে। সেখানেও নাকি দেখার আছে অনেক

আমাদের জ্যামিতিক পশু
আমাদের জ্যামিতিক পশু


আজকে সকালে আম্মা একটা জ্যামিতিক প্রাণী কিনেই ফেলল । হাসিলের খরচ বাঁচাতে ধানমন্ডির রাস্তায় ছাগলের পাল নিয়ে বের হয় ব্যাপারীরা। খরগোশ সাইজের এই ছাগলটার দাম ৩৫০০! রাস্তায় একটা বাছুর দেখলাম যার দাম দশ হাজার। যেটাকে গরু গরু বলা যায় তার দাম সাতাশ হাজার.. দিনকাল মোটেও ভালো না..


বসুন্ধরা সিটিবসুন্ধরা সিটি
বিকেলে গেলাম বসুন্ধরা সিটি মলে। লেটেস্ট মডেলের সেলফোনে ভরা সব দোকান। প্রচুর মানুষ যে কাঁচা পয়সা নিয়ে ঘোরে সেটা বোঝা যায়..

নকিয়ার রোডশো
নকিয়ার রোডশো


নকিয়ার রোড শো হচ্ছিল। টাইট টিশার্ট পড়া অ্যাটেডেন্টকে দেখেও কেন লোকে ভীড় জমাচ্ছিলো না সেটা একটা রহস্য।


সিডি/ডিভিডির ফ্লোরে চমক অপেক্ষা করছিল। তিন হুজুর প্লেস্টেশনে ফুটবল খেলায় নিমগ্ন। ওয়াও! আরেকটু আগাতেই দেখি এক দোকানে একটা ফরাসী মুভি নাম, Baise Moi, ইংরেজীতে Fuck Me। কুখ্যাত যৌনউদ্দীপক ছবি হিসেবে সারা দুনিয়া ব্যাপী সমালোচিত এই সিনেমার সরবরাহ ঢাকায় দেখে আমি যারপরনাই চিন্তিত। যাবার আগে দেখেছি লোকে ক্যানিবাল হলোকাস্ট দেখে। আমাদের উন্নতি দেখি সব দিকেই।


তবে ডিভিডি কিনে গিয়ে একটা অসাধারন ডকু দেখা হল কাল, মাইকেল মুরের সিকো
এক কথায় অসাধারন.. । মার্কিনি লোলুপ স্বাস্থ্যব্যবস্থার চরম দুর্বলতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেন পরিচালক। সচলপাঠকের প্রতি জোর অনুরোধ পারলে একবার চেখে দেখবার, পস্তাবেন না গ্যারান্টিড..
আমাদের কেন একটা মাইকেল মুর নেই? ধ্যাৎ, বরং আনিলার কথাই ভাবি..

কালেক ঈদ, শুভেচ্ছা সবার জন্য..

"দিয়েছিলে যা.. নিতে পারো সবই..... লা লা লা.."

Wednesday, December 19, 2007

ঢাকার চিঠি - ০১

সাইন্স ল্যাব মোড়েঢাকায় পৌছেছি ১৫ তারিখ ভোরে। প্লেন মাটিতে নামার আগেই টের পেলাম হোম টার্ফে খেলা শুরু হয়ে গেছে। প্লেনে সেলফোন কেন অন করা হল এই নিয়ে দুভদ্রলোক তুমুল তর্ক জুড়ে দিয়েছেন। দু গেলাস রেড ওয়াইন আর তিনটা বিয়ার খেয়ে একটা সুখনিদ্রা দিয়েছিলাম, মহাশয়দের কল্যাণে আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠতে হল।

ঢাকায় ইমিগ্রেশন পার হতে আমার "ব্যাপক" ভয় হয়। সেই ভয়ের পাছায় লাথি মেরে অফিসার ভদ্রলোক আমাকে চটপট ছেড়ে দিলেন। লাগেজ হাতিয়ে যখন বের হলাম, তখন বাবা হাত-পা ছুঁড়ে আমার চোখে পড়ার চেষ্টায় ব্যস্ত।

ঢাকার রাস্তায় তেমন পরিবর্তন নেই। অনেকদিন বড় রাস্তায় নোংরা আর ধূলো দেখিনা বলে কিঞ্চিত ধাক্কা খাওয়াটা স্বাভাবিক, কি আর করা!

এবার শুরু থেকেই আমি ভীষন অর্গানাইজড। পিডিএতে টুডু লিস্টে তোলা সব। তাতে ১ নম্বরে লেখা যোগাযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠাকরন আর ০ নম্বরে লেখা এটিএম কার্ড এর কার্যকারিতা নিশ্চিতকরন।

সকাল হতেই, মেব্যাংকের হলুদ কার্ডটা নিয়ে স্ট্যানচার্ডের এটিএম এর লাইনে দাড়ালাম। লম্বা লাইন সেখানে। সে আশায় একখাবলা বালি আর খানিকটা সুরকি ঢেলে কার্ড কাজ করলো না। যেসব কার্ডের পেছনে আর ATM মেশিনে PLUS সাইনটা থাকে তারা একে অপরের সাথে কথা বলতে পারে। মুস্কিল হল স্ট্যানচার্ডের ATM চূড়ান্ত মূক-বধিরের মতো কার্ডটা উগড়ে দিল। ভাগ্যিস HSBC বেশী দূরে ছিল না, শেষ রক্ষা হল সেখানে।

রাইফেলস স্কয়ারে ৩০০ টাকায় GP এর কানেকশন নিয়ে ফেললাম। দেশ অনেক এগিয়ে গেছে, সবাই এখন মোবাইল ডেটা সার্ভিস দেয়। প্রতি কিলোবাইট ডেটা মাত্র ২ পয়সা, আমাকে আর কে পায়! বাংলাদেশের মতো জায়গায় রাস্তাঘাটে নেট পাওয়াটা পরম সৌভাগ্য বলতেই হবে। আমার কাছে মনে হয়েছে এই সুযোগকে ব্যবহার করে অনেক কিছু করে ফেলা সম্ভব, আমার বিশ্বাস অল্প দিনের মধ্যেই আমরা সেই সুফল পেতে শুরু করবো। আরেকটি জিনিস আসলেই উল্লেখ করার মতো, সেটা হল, রাস্তারঘাটে মোবাইল টেলিফোন সার্ভিস বিক্রি করার দোকান। এদের সম্বল একটা সেলফোন আর একটা টুল। মাত্র ৪০০০ টাকা পুঁজিতে একটা মানুষ যদি চাহিদাযুক্ত ব্যবসা শুরু করতে পারে তাহলে তাকে অ্যাপ্রিশিয়েট না করাটা অন্যায় হবে!

বিকেলে আজিজে গেলাম সচল সমাবেশ দেখতে। লাল্লু অমিত (আহমেদ), সুজন অমিত, চোরা বলাই, ডেয়ারিং পিলু ভাই, অমায়িক বিপ্লবদা, ডটু রাসেল, ঝরাপাতা, মেন্টাল, অপালাদি এদের দেখে বুকটা ভরে গেল। এক বছর পর আবার একসাথে হতে পারাটা বড় আনন্দের। আমি আমার ইশকুলের বন্ধুদের সাথেও এভাবে কখনও আলিঙ্গন করা হয় না, টানটা কিভাবে যে এতো আন্তরিক হয় সেটা এক অদ্ভুত রহস্য!!!

নতুন মানুষদের মধ্যে ছিলেন লীলেন ভাই আর মুজিব মেহেদী। বস্তিবাসী লীলেন ভাই চমৎকার লোক, ভারী গলায় আদর করে করে শব্দ উচ্চারন করেন। ফর্সা দিলের এই গুনধর সচলকে গুরু মানতে হবে। মুজিব মেহেদী কথার বলার চেয়ে শোনাতে বিশ্বাসী। অমায়িক এই ভদ্রলোকের সাথে যেটুকু সময় আড্ডা দিলাম তাতে ভালোই লাগলো।

লীলেন ভাই এর ষড়যন্ত্রে আমাকে একটা লেকচার ঝাড়তে হয়েছে। কথা বলার মাঝে খেয়াল করলাম উপস্থিত অনেকের মাঝে কিঞ্চিত অসহায়ত্ব। কবিতার মাঝে ইউনিকোডের প্রসঙ্গ টানাটা কতো বিপদজনক হতে পারে এই প্যাঁচালটা পাড়তে গিয়ে জানা গেল..

সে রাতে সচল ভুড়িভোজটা খাসা হয়েছিল। কি মেনু জানতে চান? চিতল মাছের কোপ্তা, মুরগীর রোস্ট, রুই মাছের পেটি, আচার, ডাল আর সাদা ভাত... সচল সমাবেশ হবে আর তাতে ভুড়িভোজ হবে না তা কি করে হয়!

গতকাল আর আজ বিকেল পর্যন্ত ব্যস্ত ছিলাম গাড়ি ঠিক করতে । বিকেলে পিলু ভাই হাজির, গেলাম আজিজে। রাসেল ভাই ছিলেন সেখানে। দুজনে সচলের টি-শার্ট পরে এসেছিলেন। খুব শখ ছিল রাসেল ভাইকে মডেল বানিয়ে কিছু ছবি তোলার। কিন্তু ওনার ছবি প্রকাশ হলে মার খাবার ব্যাপক সম্ভাবনা আছে, তাই আপাতত ফোটোসেশন হল না।

..
পিলু ভাইকে বিশাল ধন্যবাদ, বছর দেড়েক পর গরুর চাপ খেলাম। দুটো চাপ আর আটটা লুচি, উমম!!
আরেকটু পরে দেখা হল কৌশিক আর শরতের সাথে। তবে নটার আগেই আড্ডা ভেঙ্গেছে আজ।

এক বছর ঢাকা কেমন লাগলো? হুমম। টিভি চ্যানেল গুলো মান বেড়েছে। ATN এখনও অখাদ্য নাটক দেখায়। পালের নতুন ভেড়া Islamic TV। ইন্ডিয়ার বিখ্যাত একটা রামছাগল জাকির নায়েক। এই রামছাগলটার ছাগলামী বাংলায় ডাব করে প্রচার করাটা দেখে আমি ব্যাপক আনন্দিত!!! ইয়েহ রাইট!!!

মোবাইল ফোনের সার্ভিসে (বিশেষত GP) সুবিধা হয়েছে অনেক। আমি সাকসেসফুলি আমার PDA ফোনে চব্বিশ ঘন্টা অনলাইন থাকতে পারছি, রাস্তাঘাটে MSN এ আলাপ, কিংবা Google Maps এ ঢাকার রাস্তা দেখা কতো কিছুই না করা যায় এখন!!!

রাস্তায় গুরু ছাগল দেখা যাচ্ছে না তেমন। শুনলাম দাম নাকি চড়তির দিকে! কালেক চেক আউট করতে হবে।

শেষ করি একটা মজার খবর দিয়ে। আমাদের সময় পত্রিকার ১৭ তারিখে বের হয়েছিল।
আমাদের সময়

Monday, November 12, 2007

ঈগলদ্বীপে আরেকবার


রোডট্রিপ জিনিসটা সবার হজম হয়না। মোটাভাই আর ভাবীর ক্ষেত্রে সেটা খাটলো না। তারা কুয়ালা তেরেঙ্গানু ট্রিপে বের হয়ে ব্যাপক মজা পেয়ে গেলেন। তাই ফেরার পথেই আমরা ঠিক করেছিলাম দীপাবলীর ছুটিতে আবার বের হবো।

দীপারায়ার ছুটি কাছে এগিয়ে আসতেই ঝামেলা শুরু হয়ে গেল। শখ ছিল রেদাং দ্বীপে ঢুঁ মারবার, এমন ফটিক স্বচ্ছ নীল পানি আর বাহারী মাছের দেখা নাকি খুব সহজে দেখা যায় না। গোল বাঁধালো আবহাওয়া, নভেম্বরে এখানে বর্ষা শুরু হয়, উত্তরের সব দ্বীপগুলোতে তখন হোটেল/মোটেলগুলো বন্ধ করে দেয় মাস তিনেকের জন্য। কি করা যায়! ট্রিপ কি ভেস্তেই যায়? স্মোকিং রুমে দেখা হল অ্যাডাম রাফায়েনস্কির সাথে। ব্যাটা চান্স পেলেই সমুদ্রে যায় স্কুবা ডাইভিং করতে।

“লাঙকাওয়ি যাও, এটাই ভালো সময়”, কেন্টের স্টিকে টান দিয়ে অ্যাডাম মাথা দুলিয়ে বলতে থাকে, “ফাইভ আওয়ার্স টু কুয়ালা কেদাহ, দেন টেক আ ফেরী টু দ্য আইল্যান্ড”
আমি আর মোটাভাই চোখাচোখি করি, রাজী না হবার কারনই নেই।

আমরা রওনা দেব ৭ই নভেম্বর, বুধবার। অফিস করেই বের হয়ে পড়ার ধান্দা। আমি আবার সম্প্রতি একটা স্মার্টফোন কিনেছি শখ করে, তাতে হাইস্পীড ইন্টারনেট আর জিপিএস বসানো আছে, তাই হারিয়ে যাবার সম্ভাবনা নাই। লাও ইয়াত প্লাজায় গিয়ে তাতে ২০০৭ এর ম্যাপ লোড করে আনলাম, সাথে গুগলম্যাপস ফর মোবাইল। গুগলম্যাপস ফর মোবাইল কঠিন বস্তু! গুগল আর্থকে কেঁটেছেঁটে মোবাইলফোনের জন্য তৈরি করছে গুগল। সাধারন জিপিএস এর ম্যাপ যেসব স্থান কাভার করে না, গুগলম্যাপস সেসব জায়গায় বেশ কাজে আসে। মুস্কিল একটাই, মোবাইলে ডেটা কানেকশন থাকা চাই পুরোটা সময়, ফলে পয়সা খরচের একটা ব্যাপার থেকেই যায়।

প্রথমে প্ল্যান ছিল রাত একটার বাস ধরে কুয়ালা পারলিস চলে যাব, সেখান থেকে ফেরী নিয়ে লাঙকাওয়ি। বাস ধরতে হলে একটা তাড়াহুড়োর যন্ত্রনা থাকে। শেষে ঠিক হল গাড়ি নিয়েই যাব কুয়ালা কেদাহ পর্যন্ত, সেখানে তিন দিনের জন্য গাড়ি রেখে ফেরী ধরে গন্তব্যে পৌছানো হবে। কুয়ালা কেদাহ যেতে ঘন্টা পাঁচেক লাগে, যেতে হয় ইপো-র উপর দিয়ে। এই রাস্তার ব্যাপক সুনাম অসম্ভব সুন্দর চারপাশের সব দৃশ্যাবলীর জন্য। রাত একটার যাত্রা শেষপর্যন্ত শুরু হল ভোর তিনটায়। আমাদের মতো পাগল না হলে রাত তিনটায় কেউ রোডট্রিপে বের হয় না, স্পেশালী যখন আকাশ ভেঙ্গে ঝড় বাদল হতে থাকে।

কুয়ালা কেদাহ পৌছতে পৌছতে সকাল নটা বেজে গেল, টোল দিতে হয়েছে প্রায় ৩৫ রিঙ্গিত! কেদাহ থেকে লাঙকাওয়িতে ঘন্টায় ঘন্টায় ফেরী যায় (সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত যদিও), ১৮ রিঙ্গিত করে টিকেট। ফেরীতে ঠেসে মানুষ তোলে, তাই বসতে কিছুটা কষ্ট হয়। কিন্তু দেড়ঘন্টার ফেরীযাত্রার পরে যখন লাঙকাওয়ি দ্বীপ চোখের সামনে হাজির হয় তখন আর ক্লান্তি শ্রান্তি কোনটাই মাথায় থাকে না। দুপুর দেড়টার সময় আমরা যখন কুয়াহ (লাঙকাওয়ির সী-পোর্ট) জেটিতে পা দিলাম তখন আমাদের চারজনেরই মুখেই আকর্ন বিস্তৃতহাসি!

রাতের চেনাঙ সৈকত
রাতের চেনাঙ সৈকত

লাঙকাওয়ি নামের উৎস নিয়ে অনেক গল্প আছে। ভাষা মালায়াতে “হেলাঙ” মানে মেছো ঈগল, আর “কাওয়ি” (সংস্কৃত) মানে মার্বেল। এই দুটো জিনিসই এখানে প্রচুর পাওয়া যায় বলে নাকি এই দ্বীপের নাম “হেলাঙকাওয়ি”, পরবর্তীতে, “লাঙকাওয়ি”। অন্য সূত্রানুসারে, “লংকা” (সংস্কৃতে যার অর্থ সৌন্দর্য) ও “য়ি” (সংস্কৃত, অসংখ্য) এদুটি শব্দের সন্ধিতেই “লাঙকাওয়ি” নামের জন্ম।

লাঙকাওয়ি দ্বীপটি কেদাহ-এর সুলতানিয়াতের অংশ ছিল। কিছু দিন থাই ও ব্রিটিশরাজের অধীনে থাকার পর এটি মালেশিয়ার অংশ হয়। জলদস্যুদের ঘাঁটি হিসেবে কুখ্যাত এই দ্বীপটি এখন মালেশিয়ার সবচে’ জনপ্রিয় টুরিস্ট স্পটের একটি এবং এর পিছনে সম্পূর্ন অবদানই সেই ড. মাহাথিরের। মাহাথির চালাক মানুষ। পুরো দ্বীপটাকে ডিউটি ফ্রি করে দিয়েছেন, সাগর তীরে পানির দামে মদ খাওয়া আর ফুর্তি করতে চাইলে লাঙকাওয়িতে না এসে কি পারা যায়?

কুয়াহ জেটিকে সাজানো হয়েছে এয়ার পোর্ট স্টাইলে, চোখ ধাধিয়ে যাবে নিসন্দেহে। জেটিতে নেমেই আমার প্রথম ধান্দা হল টাকা তোলা, এ দ্বীপে এটিএম মেশিন তেমন একটা নেই, তাই মোটা অংকের টাকা তুলে নিতে হবে সাথে, ক্রেডিট কার্ড এর কদর তেমন একটা নেই এখানে। টাকা তুলবার পর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ন কাজ হল একটা গাড়ি যোগাড় করা। গাড়ি নিতে লাইসেন্স থাকতে হবে, সেটা আসল নকল যাই হোক না কেন। পাজেরো থেকে মিনি সবই ভাড়া দেবার জন্য সাজানো, আমি হ্যাচব্যাক চালিয়ে অভ্যস্ত তাই একটা কেলিসা নিয়ে ফেললাম। কেলিসা ছোট্ট ছিমছাম গাড়ি, দিন প্রতি ৮০ রিঙ্গিত ভাড়া। মোটাভাই ৯০ রিঙ্গিতে একটা প্রোটন ভিরা নিলেন (নিশান সেন্ট্রা নিলে ১৩০)।

লাঙকাওয়ি দুর্দান্ত সব হোটেল আছে, তাদের প্রাইভেট বীচ-ও আছে। প্রাইভেট বীচ শুনতে আহামরি হলেও সুস্বাদু নয়। আমদের গন্তব্য পানতাই চেনাঙ বা চেনাঙ সৈকত। চেনাঙ সৈকতের ধারে অনেকগুলো চমৎকার মোটেল আছে, মানুষও যায় প্রচুর, তাই একটা উৎসবমুখরতা থাকে সবটা সময়। গেলবার ছিলাম এবি মোটেলে, এবারো রুম খালি পেয়ে উঠে গেলাম। এবি মোটেল এর ভাড়া ৯০ রিঙ্গিত। এসি রুম, দুটো ডাবল বেড। ওয়াইফাই আছে, আছে সাইবার ক্যাফে, লন্ড্রী, রেন্ট-এ-কার (এবং মোটরবাইক ও সাইকেল)। জানিয়ে রাখলে টুর ম্যানেজ করার ব্যবস্থাও আছে। মোটের উপর এর চেয়ে সস্তায় আর ভালো কিছু পাওয়ার কথা ভাবাই যায় না। এদের খাবারও খুব ভালো, আর দামেও কম।

এবি মোটেলের ঠিক সামনেই সৈকত। সৈকতে শুয়ে বসে বইপড়া আর খেলাধুলা নিয়ে ব্যস্ত সবাই। যাদের বেশী শখ তারা কেউ জেটস্কি নাহলে প্যারাগ্লাইডিং করে ফিরছে। আমরা গেছি রিল্যাক্স করতে, পানিতে পাডুবিয়ে বসে থাকতে পারলেই চলে।

লাঙকাওয়িতে দেখার জিনিস আছে প্রচুর। বার্ডপার্ক আর আন্ডারওয়াটার ওয়ার্ল্ড চমৎকার জায়গা । তবে তার চাইতে স্পীডবোটে চড়ে আইল্যান্ড হপিং এ বের হওয়া কিংবা ম্যানগ্রোভ বনে ঘুরে আসলে ভালো লাগবে বেশী। তবে চরমতম আকর্ষনীয় হল পুলাউ পায়ারে মেরিন পার্ক দেখতে যাওয়া। প্রায় ২০০ রিঙ্গিত লেগে যেতে পারে যদি স্কুবা ডাইভিং করার ইচ্ছা থাকে। পুলাউ পায়ার ছোট্ট দ্বীপ, এর ফটিক স্বচ্ছ পানিতে হাজারো রঙিন মাছের বাস, স্নোরক্লিং পাগলদের তীর্থস্থান বলা যেতে পারে (যেতে গেলে অন্তত একদিন আগে বুকিং দিতে হয়, না হলে পস্তাতে হবে আমার মতো)।

প্রথম দিন মাশীদ আব্দার শুরু করলো রাজকন্যা মাহশুরীর মোসেলিয়াম দেখবে বলে। মাহশুরীর বিয়ের কথা ছিল কেদাহর সুলতানের সাথে। কিন্তু মিথ্যা ব্যভিচারের দায়ে তাকে মৃত্যূদন্ড দেওয়া হয়। মাহশুরী মরবার আগে অভিশাপ দিয়ে যান লাঙকাওয়ি দ্বীপকে। মোসেলিয়াম এ হাজির হয়ে হতাশ হয়ে ফিরতে হল। টুরিস্টদের পকেট হাতড়ে দুটো টাকা নেওয়ার জন্য এরা মহা তৎপর।

ফেরার পথে কুয়াহ থেকে একটা ম্যালিবুর বোতল কেনা হল (শোমচৌ এর কুবুদ্ধি!), সৈকতে থাকবো আর ক্যারিবিয় পানীয় গলায় ঢালবো না তা কিভাবে হয়!

প্রচুর টুরিস্ট আসে বলে এখানে দোকান পাটের সংখ্যা কম নয়। শুধু চেনাঙ সৈকতের ধারেই দেখা যাবে শ’খানেক দোকান-কাপড়, জামা, জুয়েলারী, কিউরিউ কিংবা কনভিনিয়েন্স! অনেক কিছুই কেএল এর সেন্ট্রাল মার্কেটে পাওয়া যায়। কিন্তু সেন্ট্রাল মার্কেটের কথা আর কজনই বা জানে?

পরদিন সকালে মোটাভাই এর গাড়িতে চড়ে আমরা বের হলাম গুনুঙ রায়া পাহাড়ের দিকে। গুনুঙ রায়া এই দ্বীপের সর্বোচ্চ পাহাড়। এই চূড়োয় গেলে নাকি থাইল্যান্ডও দেখা যায়। মোটাভাই ভালো পাইলট, ভয়ঙ্কর আঁকাবাঁকা পাহাড়ী রাস্তায় গাড়ি তরতরিয়ে নিয়ে গেলেন। পাহাড়ী রাস্তার দুপাশে ঘন ট্রপিকাল রেইনফরেস্ট। খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে সব উঁচু উঁচু গাছ। একটু পর পরই রোড সাইন, সর্তক করে দিচ্ছে সাম্ভাব্য পাহাড়ী ধ্বস থেকে। রাস্তাধরে কিছু দূর যাই আর দেখা হয় একদল বানরের সাথে। এই দ্বীপে এতো বানর আছে সেটা জানা ছিল না। গুনুঙ রায়ার মাথায় কারা যেন রিসর্ট বানাচ্ছে, এখনো পুরোটা শেষ হয়নি, আমরা তারই পার্কিং এ গাড়ি রেখে দৃশ্য দেখতে বের হলাম। উচ্চতম শৃঙ্গ থেকে এই স্বপ্নদ্বীপ দেখা এক অসাধারন অভিজ্ঞতা।

পাহাড় চুড়োয় বেশ ঠান্ডা, ভ্যাপসা গরমের দেশে বড়ই আরামদায়ক, উপরন্তু গাড়ির এসি কাজ করছিল না! মিনিট বিশেক থেকেই আমরা নামতে গেলাম। মাঝপথে বিচিত্র আওয়াজ শুনে গাড়ি থামলো। এ যে ধনেশ পাখি! এর আগে পাঙকোর দ্বীপে ধনেশ দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। এখানে আবার দেখে ছবি তুলতে গেলাম। ভীতু পাখিটা ক্যামেরা টের পেয়েই ভাগলো। কপাল ভালো ছিল, একটা শট কোনমতে নেওয়া গেছে!

গুনুঙরায়া পাহাড়ে দেখা ধনেশ পাখি
গুনুঙরায়া পাহাড়ে দেখা ধনেশ পাখি

গাড়ি আবার চলা শুরু করলো, হঠাৎ ভীষন বাজে গন্ধ! নাড়িভূড়ি দলা পাকিয়ে বের হয়ে যায় যায়। পিছনে কিছু একটা পড়ে আছে, সম্ভবত গন্ধ সেখান থেকেই। মোটাভাই খাড়া রাস্তায় রিভার্সে যাওয়া শুরু করলেন, কৌতুহল কঠিন জিনিস। কাছে গিয়ে ছবি তোলা গেল না, অসম্ভব পচাঁ গন্ধ যে! কিন্তু আমরা হতবাক, জিনিসটা আর কিছুই না, পাচঁ ফুট লম্বা একটা অজগর, সম্ভবত গাড়ি চাপা পড়ে মারা গেছে কদিন আগে, সেটাই পঁচে গিয়ে দুর্বিষহ গন্ধে পাগল করেছে চারদিক!

ম্যানগ্রোভ জঙ্গল
ম্যানগ্রোভ জঙ্গল

ম্যানগ্রোভ জঙ্গলের বানর
ম্যানগ্রোভ জঙ্গলের বানর

দুপুরে লাঞ্চ করে আবার অভিযান, এবার যাত্রা ম্যানগ্রোভ বনে। সাগরের নোনা পানির পাড়ের গাছগুলোতে শ্বাসমূল জন্মায়। সুন্দরবনে এমন গাছ প্রচুর, এখানেও যে আছে সেটা জান্তাম না। স্পীড বোটে করে ছোট খাড়ি ধরে যাচ্ছি আমরা। দুপাশে ঘন বন। তাতে যতো না পাখি তার চেয়ে বেশী বানর।

দীর্ঘকান্ডের নিরক্ষীয় বৃক্ষরাজি
দীর্ঘকান্ডের নিরক্ষীয় বৃক্ষরাজি

নৌকাওয়ালা আমাদের তীরে নামিয়ে দিয়ে হাতে একটা টর্চ ধরিয়ে দেয়। তারপর পট করে গায়েব হয়ে গেল। ম্যানগ্রোভ বনের মাঝে কাঠের ব্রীজ, সেই ব্রীজ ধরে যেতে হবে। আমাদের গুহা দেখবার শখ বড়, বলা হয়েছে সামনে পড়বে বাদুরগুহা। গুহামুখ দেখতে পেয়ে ঢুকে গেলাম। স্ট্যালাকসাইট (stalactite) এর কথা ভূগোল বইতে পড়েছিলাম, চাক্ষুষ দেখার সুযোগ পেয়ে মন্দ লাগলো না। এদিকে মোটাভাই টর্চ নিয়ে বাদুড় খুঁজতে উঠে পড়ে লেগেছেন। আমি ব্যস্ত ছবি তোলায়। ফ্ল্যাশ জ্বলতেই অবাক, পুরো গুহার ছাদ জুড়ে হাজারো বাদুড় ঝুলে আছে! ভাগিস্য এরা অযথা উড়ে বেড়ায় না! নাহলে প্যানিক করে মাশীদ আর বর্না ভাবী মারা যেত!


বাদুড় গুহা
বাদুড় গুহা

কুমির গুহায় দুঃসাহসী মহিলারা!
কুমির গুহায় দুঃসাহসী মহিলারা!

ম্যানগ্রোভের ধনেশ
ম্যানগ্রোভের ধনেশ


বাদুড় গুহা দেখে নৌকা রওনা দিলো মোহনার দিকে। সেখানে জাল দিয়ে ঘেরা জায়গায় অদ্ভুত সব মাছ দেখিয়ে পয়সা কামাচ্ছে এক মালে পরিবার। জলজ্যান্ত মোরে ঈল, স্টিং রে, স্টিং কাকড়া, ব্যাটফিশ এবং আরো অনেক মাছ। মাশীদ খুব শখ করে স্টীং রে টাকে টুনার টুকরা খাওয়াবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু মাছটা এতো এগ্রেসিভ যে বেচারী সাহস পেল না বেশীক্ষন চেষ্টা করার।
নৌকাওয়ালাকে কোক ঘুষ দেবার বদৌলতে সে মোটাভাইকে ওপেন সী-তে বোট চালানোর অফার দিয়ে বসলো। মোটাভাই চারচাক্কার ওস্তাদ, প্রপেলারের ওস্তাদ হবার সুযোগ ছাড়েন কি করে!

ম্যানগ্রোভের শ্বাসমূল
ম্যানগ্রোভের শ্বাসমূল

রাতে আমরা খেলাম ভারি চমৎকার একটা রেস্তরায়, নাম রোজ টি। থাই খাবারের দোকান। বলা দরকার যে এই দ্বীপটি থাইল্যান্ড থেকে ৪৫ মিনিট দূরে, আর আগে শ্যাম রাজের অধীনেও ছিল। তাই থাইদের প্রভাব আছে ভালোই।

তৃতীয় দিনে আমার যাবার কথা ছিল পুলাউ পায়ারে। বুকিং না দেওয়ায় যাওয়া হল না। মন খারাপ করে মাশীদকে নিয়ে বার্ড পার্কে গেলাম। গতবার বার্ড ফিডিং করতে গিয়ে মজা হয়েছিল। পাখি দিয়ে ছেয়ে গিয়েছিল সারা শরীর। এবারো খাবার কিনে ঢুকলাম ভিতরে। পাখিরা এবারে তেমন খাবার ধান্দায় না থাকলেও, একটা কালো বানর ব্যাপক সৌজন্যের সাথে মাশীদের দেওয়া বাদাম খেয়েছে। এক পর্যায়ে আমার স্ত্রী বলেই ফেললেন এই বাদরটাকে কোলে নিয়ে তিনি সারা জীবন বাদাম খাওয়াতে রাজী। চিন্তার বিষয়!


বার্ড পার্ক থেকে ফিরতে গিয়ে জানলাম আইল্যান্ড হপিং এ পুলাউ বেসারে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানকার হালকা ঘোলা পানিতে কিঞ্চিৎ স্নোরক্লিং করা যেতে পারে। আর যায় কোথায়। আমি লটকে গেলাম। স্পীডবোটে প্রায় আটজন যাত্রী, লাইফ জ্যাকেট পরা সবারই। সাগরে ভীষন ঢেউ ওঠে, সাবধান না হলে অঘটন ঘটে যেতে পারে। আমার কিছু হয় নি, শুধু একপাটি জুতো গায়েব হয়ে গেল!


দুয়ুঙ দ্বীপের কালো বানর
দুয়ুঙ দ্বীপের কালো বানর

আইল্যান্ড হপিং এর প্রথম কাজ হল ঈগল ফিডিং। পানিতে টুনার টুকরো ছুড়ে মারা হয়, লাঙকাওয়ির বিখ্যাত সব “হেলাঙ” (মেছো ঈগল) ছোঁ মেরে তা খেতে আসে। সেই দৃশ্য ক্যামেরা বন্দী করতে বড় বেগ পেতে হল।
লাঙকাওয়ির ঈগল - ১
লাঙকাওয়ির ঈগল - ১

লাঙকাওয়ির ঈগল - ২
লাঙকাওয়ির ঈগল - ২

পুলাউ বেসার গিয়ে দেখি কেউ লাইফ জ্যাকেট ভাড়া দেয়না। অগত্যা সেটা ছাড়াই হাটু পানিতে স্নোরক্লিং করতে নামলাম। লাভের মধ্যে লাভ হল, লাইফ জ্যাকেট ছাড়াই পানিতে ভাসা শিখে গেলাম! এবার একটা জোড়া ফ্লিপার কিনতেই হবে দেখছি!

মাশীদও পানি দেখে নেমেছিল, তবে বেচারী কেন যে ঠিক সুবিধা করতে পারলো না বোঝা গেল না। এনিওয়ে ৩৫ রিঙ্গিতের এই ট্রিপটার আনন্দ কোন অংশেই কম না। দুঃখ শুধু পুলাউ পায়ারের জন্য।

সন্ধ্যায় মাশীদ আর বর্না ভাবী শখ হল শাড়ী পড়ে সাগরে নামার। সুর্যাস্তে নামার প্ল্যান থাকলেও তারা নামলো আঁধার হয়ে যাবার পরে। লো লাইটে বহু কষ্টে ছবি তুলতে হল।

আমি জীবনের প্রথম মার্গারিটা খাই এই চেনাঙ বীচে। বার টেন্ডার দেখতে ছিল একেবারে বব মার্লের ছোট ভাই। এবার তাই মাশীদেরও শখ ছিল এদের মার্গারিটা চেখে দেখার। খোঁজ নিতেই জানা গেল বারটা উঠে গেছে। সামনে আরেকটা বার দেখে বসে গেলাম। একদম খোলা সৈকতে টেবিল। ককটেইল আর তাপাস পাওয়া যাবে। মার্গারিটার সাথে আন্দালুসিয়া ক্যালামারী আর সফ্ট শেল ক্র্যাব ফ্রিটার নেওয়া হল তাপাস হিসাবে। ক্যালামারী হল রিঙ এর মতো করে কেটে ডিপ ফ্রাইড স্কুইড! সফ্ট শেল ক্র্যাব আমার অতি প্রিয় জিনিসের একটা। সদ্য খোলস বদলানো কাকড়ার খোসা খুব নরম হয়, চিবিয়ে খেতে সমস্যা হয় না। এখন সেই জিনিসকে যদি টেম্পোরা স্টাইলে ভাজা হয় তখন তার স্বাদ হয় অমৃততূল্য! মুস্কিল হল, তাপাসের স্বাদ লোভনীয় হলেও মার্গারিটা ছিল চরিত্রহীন। চরিত্রহীন মার্গারিটা খাওয়া মহা অন্যায়!

যাই হোক, ছোট্ট এই ছুটিতে লাঙকাওয়ি দেখা সহজ নয়। বুধবার গিয়ে রোববারে ফিরে আসতে হলে মন খারাপ হয়ে যায়। কি আর করা! সোমবারে তো অফিস। কতো জায়গা এখনও দেখা হয়নি, পাহাঙ, কাপাস, রেদাঙ, পেরহেন্থিয়ান... ধূর! আবার কবে যে একটা লঙ উইক এন্ড পাই?

সৈকতে মাশীদের সিলুয়েট
সৈকতে মাশীদের সিলুয়েট


Saturday, September 15, 2007

সাবা-কান্ড

বহুদিন ধরেই শুনছিলাম রিস্কি হামিদ আর অফিসের আরো কয়েকজন মিলে টিমবিল্ডিং সেশন নিয়া নানা পরিকল্পনা করে যাচ্ছে। মাল্টিন্যাশনালে বহুরকম মানুষ কাজ করে, তাদের মাঝে দূরত্ব কমাতে টিমবিল্ডিং এর নামে একসাথে খেলাধুলা আর ফুর্তি করা হয়। সে যাই হোক, গরম ইসু যেটা ছিল তা হল টিমবিল্ডিং এর জন্য যাওয়া হবে কোথায়? রিস্কি চায় বালি যেতে, আরেকদল বলে চল ইস্ট মালেশিয়ায়। আমি একটা নিরস ডিপার্টমেন্ট কাজ করি বলে এসব নিয়ে মাথা ঘামাই না। ডানহিলে লম্বা টান দিয়ে অন্য চিন্তায় মন দেই।

মালাক্কা থেকে ফিরেই রিস্কির সাথে দেখা।
"৩ তারিখে কিন্ত সাবা যাচ্ছি, মনে রাইখো" "সাবা? আমার ভিসায় তো বলা ওনলি ফর ওয়েস্ট মালেশিয়া.. সাবায় যাবো কিভাবে?" "ওইখানে গেলেই দিবেনে.. পাসপোর্ট সাথে নিও", বলে রিস্কি ভেন্ডিং মেশিনের দিকে রওনা দেয়।

মানচিত্রে মালেশিয়া ও সাবা

সাবার অনেক কাহিনী শুনেছি। এর আদ্যোপান্তই আলাদা। মালেশিয়ার মূল ভূ-খন্ডে অবস্থিত নয় এমন দুটি প্রদেশ হল সাবা আর সারাওয়াক। ম্যাপ খুললে দেখবেন সাবা, সারাওয়াক আর ইন্দোনেশিয়া আলাদা একটা দ্বীপের মতো স্থানে অবস্থিত। আবার সাবা, সারাওয়াকের মাঝে লটকে আছে ব্রুনেই। সাবাহ আর সারাওয়াক আসলে আগে ব্রুনেই এরই অংশ ছিল। প্রতিরক্ষাগত কারনে ব্রুনেই এর সুলতান এই প্রদেশ দুটোকে লীজ দেয় আমেরিকান দের। আমেরিকানদের হাত ঘুরে এর শাসক হয় ব্রিটিশরা। মালেশিয়ার জন্মকালে এরা মালে ফেডারেশনে ঢুকে পরে স্বতন্ত্র রাজ্য হিসেবে। মালেশিয়ার অংশ হলেও মালেশিয়ানদের সাবাতে ঢুকতে ভিসা লাগে (যদিও সেটা অন-অ্যারাইভাল)। মালেশিয়া সরকারও সাবার মানুষকে যতোটা সম্ভব খুশি করে চলে।

সাবা আর সারাওয়াক হল এই অঞ্চলের কিছু শ্রেষ্ঠ রেইনফরেস্ট আর ডাইভিং স্পটের জন্য বিখ্যাত। সাবার সান্দাকান দ্বীপ হল ওরাংউটান এর বাসভূমি। সিপাদান বিখ্যাত সী-টার্টল আর অসাধারন মেরিনলাইফ এর জন্য। এসব জানার পর সাবা সম্পর্কে উতসাহী না হয়ে পারা যায় না। উইকএন্ডে গেলাম লাও ইয়াত প্লাজায়। ক্যামেরার জন্য একটা আন্ডারওয়াটার কেসিং আর নতুন দুজোড়া হাইক্যাপাসিটির ব্যাটারী কিনবার খায়েস। ব্যাটারী পাওয়া গেলেও কেসিং পাওয়া গেল না, অর্ডার দিতে হবে, ডেলিভারী কমপক্ষে দু'হপ্তা, আর সবচে বড় কথা হল দাম প্রায় ষোল হাজার টাকার মতো। স্বচ্ছ প্লাস্টিকের একটা কেসিং কেন ৮০০ রিঙ্গিত দাম হবে মাথায় ঢুকলো না। মনের দুঃখে একটা শর্টস কিনে বাড়ি ফিরলাম।

অফিস থেকে বলেছে ভোর ৪টায় লবিতে জমায়েত হতে। লটবহর হাতে নিয়ে যখন পৌছালাম রিস্কি তখন ডজনখানেক কার্লসবার্গ খেয়ে পুরা আউট। আমরা প্লেনে যাব, বাজেট এয়ার লাইন, নাম এয়ার এশিয়া। বাজেট এয়ারলাইন হলে কি হবে, এরা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের স্পনসর।

আমাদের প্লেন KLIA থেকে না উড়ে, ডানা মেলবে LCCT থেকে। LCCT-কে KLIA এর ধারেকাছেও তুলনা করা যায় না। বাজেট এয়ার লাইনে এয়ার হোস্টেসরাও "বাজেট-বিউটি" নিয়ে ঘোরে সেটা জানা ছিল না। এয়ার এশিয়ার হোস্টেসদের পোষাক কিঞ্চিত আপত্তিকর-রকম ছোটখাট হলেও তাদের ভাঙ্গাচোরা চেহারা দেখে উদ্দীপনা দমে যেতে বাধ্য, এবিষয়ে মিনিট পাঁচেকের মধ্যে প্রায় সবাই মতৈক্যে পৌছাল। এদের প্লেনে সীট নাম্বার নেই। প্রায় প্লেনে ওঠার সময় প্রায় সবাই আক্ষরিক অর্থে দৌড়ায়। কোনমতে বসতে পারাই একটা বড় অ্যাচিভমেন্ট!

সাবা পৌছাতে প্রায় দুঘন্টা লাগে। প্লেন থেকে নেমে জানতে পারলাম এই শহরটার নাম কোটা কিনাবালু। এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশনে বরাবরেই মতো আমি আর রিস্কি আটকে গেলাম। ভিসায় পূর্ব মালেশিয়ার কথা নেই, মুখ গম্ভীর করে অফিসার ইতিউতি করেন। সমাধান করলেন বড়কর্তা। ৩০ দিনের প্রবেশাধিকার পাওয়া গেলে অবশেষে।

এয়ারপোর্টে টুর গাইড বাস দিনে রেডী ছিলেন। গাইডের নাম জে, চীনা আর সাবানদের মিক্স! ভীষন রসিক। আমাদের থাকার জন্য ঠিক করা হয়েছে শাংরিলার তান্জুল আরু রিসর্ট। একে ফাইভ স্টার, তারপরে সৈকতের ধারে। ২০০ মার্কিন ডলারের রিসর্টে নিজের পয়সার থাকা সম্ভব না। মনে মনে বললাম, "আহা!"

১১টার দিকে আমরা রওনা দিলাম কিলু নদীর দিকে। সেখান হোয়াইট ওয়াটার ড়্যাফটিং করার ধান্দা! প্রচন্ড আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে কিলু নদীর তীর পৌছাতে ঘাম বের হয়ে গেল।


গুগল আর্থে সাবার কিলু নদী (হলুদ মার্ক: র‌্যাফটিং শুরু এখান থেকে)


ল্যাইফভেস্ট আর হেলমেট পড়ে গেলাম ব্রিফিং এ। ১৫ মিনিট পরে আমরা সবাই ড়্যাফ্ট নিয়ে বৈঠা বাইতে শুরু করেছি। কিলু পাহাড়ী নদী, ভীষন খরস্রোতা। ড়্যাফট এ উঠে বিভিন্ন "চীপা"য় পা গুঁজে বসতে হয় যেন না পড়ে যান। স্রোত বেশী হলে ক্যাপসাইজড (ভেলা উল্টে যাওয়া) হবার ভয় থাকে। তাই প্রতি ভেলাতেই একজন দক্ষ গাইড দেওয়া হয়েছে। আমার ফিটনেস কম। একটু বৈঠা মারতেই হাত ব্যথা করে উঠলো। একটু পড়েই ড়্যাফটিং কি কতো প্রকার বোঝা গেল, প্রচন্ড স্রোতে ভেলা লাফ মারে প্রায়, কে জানি ছিটকে পড়েই গেল পানিতে।


কিলু নদীতে হোয়াইট ওয়াটার র‌্যাফটিং


বার দুয়েক আমাদের ভেলা পাথরে দড়াম করে ধাক্কা খেল। হঠাত গাইড বলল, সামনে ক্যাপসাইজ হবার সম্ভাবনা আছে। তার কথা প্রায় সত্যি করে ভেলাটা উল্টে যাবে যাবে করেও শেষমেষ টিকে গেল। হাঁপ ছাড়লাম সবাই। ড়্যাফটিং শেষে শুনি বডি ড়্যাফটিং হবে, মানে শরীর দিয়ে ভেসে ভেসেই নদীতে এগুতে হবে। বিষয়টা শুনতে যতো সহজ, কাজটা ততোটা নয়। এবং মানইজ্জতে মাথা খেয়ে আমি পানিতে খাবি খাওয়া শুরু করলাম। সারা শরীর ভাসলেও মুখ একটু পর পর পানিতে ডুবছে, না পারি শ্বাস নিতে, না পারি ভাসতে। মনে হল মরে যাচ্ছি, স্রোত ভেসে চলে যাব দূরে, সব আশা শেষ। সুযোগ পাওয়া মাত্র জবাই করা খাসীর মতো কন্ঠে চিতকার করলাম, "হেল্প, হেল্প, হেল্প!!"


মিনিট পাঁচেক পর গাইড উদ্ধার করে আমাকে। ইত্যবসরে আমার খাবি খাওয়ার ঘটনা পুরোটা ভিডিও করা হয়ে গেছে, মোটামুটি আগামী বছর তিনেক হাসির খোরাক দিতে পারবে সেটা।

দুপুরে খাওয়াদাওয়া হল নদীর কাছেই রিভারবাগের রিসর্টে। যখন হোটেলে ফিরলাম তখন প্রায় সবারই শরীররে বিভিন্ন জায়গায় ছড়ে গেছে আর টনটনে ব্যথা সব জায়গায়। টিমবিল্ডিং মাই ফুট। রাতে ডিরারের পরে দুঘন্টার জন্য ফ্রী ফ্লো শীভাস রিগ্যাল আর কার্লসবার্গ। এর পরের ঘটনা না বলাই ভালো। সকালে উঠে জানলাম রিস্কি পোল ড্যান্সে করে ফাটিয়ে ফেলেছে। আমি ছেলে ভালো। মাতাল হলে ঝামেলা করিনা। তারপরো মনে হল বলি ধরণী দ্বিধা হও।

সাগরতীরে টিম বিল্ডিং
সাগরতীরে টিম বিল্ডিং


দ্বিতীয় দিন গেলাম KK Adventure Park এ। গতদিনের ধকল আর হ্যাংওভারের ফলে লাফঝাঁপ নিয়ে কোন আগ্রহ ছিল না। চামে চিকনে শুয়ে বসে পার করলাম। তবে যখন সাগরে কায়াক (নৌকা) চালানোর ডাক এলো তখন কি বসে থাকা যায়। কায়াক চালাতে হাতে জোর লাগে প্রচুর। দশ মিনিটের মাথায় আমি আর চিয়া ওয়েন দুজনেই হাল ছেড়ে দিলাম। এর চেয়ে লাইফ জ্যাকেট পরে ভেসে থাকা অনেক মজার। রাতে ডিনার ভালো ছিল। তবে আবার মাতাল হবার কোন ইচ্ছা ছিল না। ইনাফ ইজ ইনাফ!


সাপি দ্বীপ

তৃতীয় দিনে, স্পীডবোটে করে রওনা দিলাম সাপি দ্বীপে। সবারই গভীর উত্তেজনা, কারন সী ওয়াকিং করা হবে। সী ওয়াকিং আর কিছুই না। মাথায় একটা ৩৫ কেজি্র হেলমেট পরে পানিতে নামতে হয়। পাইপে করে উপর থেকে বাতাস পাঠানো হয়, তাই অক্সিজেন ট্যাংক কাধে নিয়ে বেড়ানোর ঝক্কি নেই।

সী ওয়াকিং
সী ওয়াকিং

আট থেকে আটান্ন বছরের সবাই এই কাজটা করতে পারে অবলীলায়, যা স্কুবা ডাইভিং এর ক্ষেত্রে চলে না। সাপি দ্বীপের সৈকতে টুংকু আব্দুল রহমান মেরিন পার্ক। সেখানে হাজারো রকম মাছের আনাগোনা। সী ওয়াকিং এ আমরা সেই সব রঙবেরঙ এর মাছ গুলোই দেখবো।

আমার পালা এলো দ্বিতীয় ব্যাচে। সে এক অসাধারন অভিজ্ঞতা! মাছে মাছে মেলা বসে যায় ফটিক স্বচ্ছ নীল পানিতে। মনে হবে হাটছেন অ্যাটলান্টিসের তলদেশে। ফাইন্ডিং নিমোর সেই ক্লাউন অ্যানেমনফিশ দেখার সুযোগ হল। পোষা মাছের মতো শৈবালে ছুটে বেড়াচ্ছে সে।

সী ওয়াকিং শেষে, বাকিটা সময় কাটালাম স্নরক্লিং করে। এই কাজটা এখন বেশ ভালোই পারি। পানিতে নেমে আমি অবাক! ব্যাট ফীশ, সার্জেন্ট মেজরসহ হাজারো ডেমসেল ফিশ, প্যারট ফীশ আর কোরাল দেখে আমি পাগল! আধাঘন্টা বাদে হঠাত পায়ে কি যেন কামড়ে দিল। আমি পড়ি কি মরি করে ছুটলাম তীরে। কালো ডেমসেল মাছগুলো ডিম পেড়ে পাহারা দিচ্ছিল । আমার পদধূলি পছন্দ না হওয়া কামড়ে দিয়েছে। তীরে এসে দেখি রক্ত বের হয় ভালোই দাগ হয়ে গেছে।
ভীতু মানুষ তাই আর পানিতে নামলাম না। পরে রাও এর কাছ থেকে শুনলাম আরও বিপদের গল্প। পায়ে ক্ষত নিয়ে সে সী-ওয়াকিং এ গিয়েছিল। একটু পরে সে আবিস্কার করে মাছ গুলো রুটির টুকরো বাদ দিয়ে তার ক্ষত কামড়ে যাচ্ছে গভীর আগ্রহে। তাই সাবধানবানী: উন্মুক্ত ক্ষত নিয়ে সাগরে নামবেন না।


গুগল আর্থে টুংকু আব্দুল রহমান পার্ক, সাপি দ্বীপ এবং সীওয়াকিং স্টেশন

সাপি দ্বীপের সৈকতে
সাপি দ্বীপের সৈকতে

জেটিতে নেমেই দেখেছি জেলী ফিশের নোটিশ। রমেশ দাবী করে বসলো তারপায়ে নাকি লেগেছেও একটা। জেলী ফিশের সাথে পরিচিত না হলে বেশ বিতিকিচ্ছিরি ঘটনা ঘটতে পারে। মরন হবে না, কিন্তু জ্বলুনী মারাত্বক!
সাপি দ্বীপের ডেমসেল মাছের ঝাঁক
সাপি দ্বীপের ডেমসেল মাছের ঝাঁক

রাতে কেএল ফেরার আগে সবাই গেল ফিলিপিনো মার্কেটে ঢু মারতে। সাবার শুটকি (ইকান মাসিন) খুবই ভালো। মজার বিষয় হলো, এরা ইলিশের শুটকি খুব পছন্দ করে। দেশের মাছ বলে কথা, তাই দুটো ইলিশ কিনেই ফেললাম।
ফিলিপিনো মার্কেটে ইকান মাসিনের (শুটকি মাছ) বাজার
ফিলিপিনো মার্কেটে ইকান মাসিনের (শুটকি মাছ) বাজার

রাতে এয়ারপোর্ট যেতে যেতে মনে হল আবার আসা দরকার। সেন্দেকানে উরাং উটান সিপাদান দ্বীপের কাছিম না দেখলে চলে না। আরেকটা দেখার জিনিস মাউন্ট কিনাবালু। বলা হয় দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার সর্বোচ্চ পর্বত এটা। মেঘের কারনে এবার দেখাই হল না। নাহ, মাশীদকে নিয়ে আবার আসতেই হবে কোন দিন।