আমাদের বাড়ি বই ছাড়া আর কোন জিনিস ঠিক সহজে ঢুকতে পারতো না। আমরাও দুভাই লক্ষীছেলে হয়ে থাকতাম। চুলকাটা থেকে জামাজুতো সব বাঁধাধরা। আমার ভাই যখন বড় হল তখন দেখতাম প্রতিদিন দুপুরে রেডিওর দখল নিতে তার গভীর উৎসাহ। ওয়ার্ল্ড মিউজিক হতো রেডিও বাংলাদেশে। আমার ভাই তার একনিষ্ঠ শ্রোতা। সেই মনে হয় প্রথম ঘরের খোলস ছেড়ে পপ কালচার ঘরে ঢুকে পড়ল লুকিয়ে লুকিয়ে।
গান শুনে ঠিক কি হয় সেটা বুঝতে বুঝতে আমার অগ্রজ মিউজিক সিস্টেম কিনে তাতে এটা সেটা বাজাতে লাগলো সারাদিন। কোন একটা কারনে তাতে বাংলাগান চলতো না একেবারেই। মেজমামার বিষয়টা পছন্দ ছিল না, একবার আমি ওয়াকম্যানে গান শুনতে গিয়ে হালকা ধমক খেলাম। হেদায়েত করা হল, এসব শোনা নাকি ঠিক না, আমার শোনা উচিত রবীন্দ্রনাথের গান, নজরুলের গান।
ক্লাস সেভেনে যখন উঠলাম, তখন শরীরের ভেতরে ভাঙ্গাগড়া শুরু হয়ে গেছে। প্রেম-ভালোবাসা-যৌনতা এসব মনে প্রায়ই উঁকি দেয়। ঠিক এরকম সময়ে (১৯৯১) বাংলাদেশে ব্যান্ড মিউজিকের প্লাবন শুরু হল। সে একটা সময় বটে! দুদিন পরপর একটা করে ব্যান্ড তৈরি হয়। দুই পাতা গিটার শিখে পোলাপান বেসুরোবেতাল গলায় যাখুশি গাইতে থাকে, আর আমরাও গভীর আগ্রহে তার প্রত্যেকটা শুনি। প্লাবনের কাজই ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া, আর তাতে যদি গা ভাসাতেই লোকে বিপুল উৎসাহে অপেক্ষা করে তাহলে ফল হয় আকাশপাতাল কাঁপানো! এর আগে পপ মিউজিক বলতে আমার ধারনা আটকে ছিল জিঙ্গা গোষ্ঠী, আজম খান, ফিরোজ শাই আর ফেরদৌস ওয়াহিদের গানে। জিঙ্গা গোষ্ঠীর ভদ্রমহিলার শ্লীল নাচের সাথে গান রীতিমতো "হটস্টাফ", যদিও তারা বহু আগেই গানাবাজনা থামিয়ে দিয়ে কোথায় যেন গায়েব হয়ে গেছেন।
এরকমই একটা দিনে আমি প্রথম শুনলাম "মেলায় যাইরে"। বাংলাদেশে যা হয়, একটা কিছু পপুলার হলে সেটা বাজে দুনিয়া জুড়ে, টুয়েন্টিফোরসেভেন। ঢাকার কাক-কোকিল-কবতুরও তখন মেলায় যাইরে শুনে ফেলেছে। শোনেনি কেবল আমার মতো কিছু লক্ষীছেলে। একদিন দেখি স্কুলে আসিফ (এখন বিস্তর টাকাওয়ালা চামড়ার ব্যবসায়ী) একটা ক্যাসেট নিয়ে ঘুরঘুর করছে। আসিফ দিলদরিয়া মানুষ ছিল, চাইলে না করতো না। ক্যাসেট পেয়ে আমি লাফাতে লাফাতে বাড়ি ফিরি। তারপর দুপুর বেলা মায়ের টেপরেকর্ডারে দিলাম চালিয়ে। সে এক বিস্ফোরন বটে! গানের কথা বোঝার বয়স হয়নি, সুরতাল জানি না। কিন্তু আমার চরম উত্তেজনা, নিষিদ্ধফলের স্বাদ মনে হয় এরকমই হয়। পপ মিউজিকের হয়তো এটাই ক্ষমতা। নেশা ধরে যায়। ফিউব্যাকের টেপটা শুনতে শুনতে ছাল উঠে যায়। ভাইকে গিয়ে বলি ডুপ্লিকেট করে দিতে। মন্দ কপাল। হঠাৎই তার নীতিবোধ উথলে ওঠে, বাবার কাছে নালিশ যায় অপু "তার বুকের আলিঙ্গনে" শোনে! এসব শুনে আমার বাবার ক্যাসেটটা ছুড়ে কুয়াকাটায় ফেলে দেবার কথা ছিল। তিনি ধমকে দিলেন ঠিকই, কিন্তু নিষেধাজ্ঞা জারি হল না। আমি বাংলা ব্যান্ড মিউজিকের একনিষ্ঠ ভক্ত হয়ে গেলাম, বিশেষত মাকসুদুল হকের ডাই হার্ড পাংখা। হাজারো ট্র্যাশি গানের মাঝে আমি ফিডব্যাক শুনি, বাচ্চুর এলআরবি শুনি, মাঝেমধ্যে মাইলস্। এইসব শুনতে শুনতে বড় হলাম। এখন কান অনেক পেকেছে, শোঁপা, আলি আকবার থেকে সস্তা হিন্দীগানও। নজরুল শুনি না, কিন্তু প্রাণ দিয়ে ভালোবাসি রবীন্দ্রনাথের গান, শুনি মিলা, হাবিব, ফুয়াদ, শিরিন, কণার গান। আমার সৌভাগ্য বড় উদার কান আমার।
ইদানিং প্রায়ই মারপিট চলে কে ফালতু/কে ক্লাসি/কে নিয়মমেনে গান করে - এইসব নিয়ে। এতো বাক্যব্যয়ের কি দরকাররে বাবা! আমি শুনি, ভালো লাগে বলে শুনি। ক্যাকোফোনি আর গানের পার্থক্যাটা ধরতে পারলেই তো হয়? না কি আর কিছু লাগে? এসব ক্লান্তিকর বিতর্কে যেতে ইচ্ছা করে না। একটা গান ছিল "গান ভালোবেসে গান"। আমি বলি গান ভালোবেসে শোন!
এই হল মাকসুদ!
Monday, March 23, 2009
1 comment:
To comment in Bangla, please use Avro Keyboard Interface. Click here for Bangla Installation Guide.
বাংলায় লিখতে অভ্র কিবোর্ড ব্যবহার করুন. বাংলা ইন্সটলেশন গাইড পাবেন এখানে।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
ভাল লিখেছ, বৎস। পড়ে মজা পেলাম।
ReplyDelete