Tuesday, April 21, 2009

তিওমান দ্বীপে প্রথমবার..

প্ল্যানটা মাশীদের, তিওমান যাবে সঙ্গী হবে টিনা, ইন্দ্রনীল আর আমি বোচকা বাহক। ম্যাডামের কথা ফেলা কি যায়? যায় না... তাই দুদিন ছুটি নিলাম।

তিওমান এই প্রথম যাচ্ছি। মালেশিয়ার শ্রেষ্ঠ বীচের একটা রেদাং আরেকটা তিওমান। তিওমান যাওয়া সহজ নয়। প্লেন এ যাওয়া যেত, শখও ছিল। কিন্তু বেরজায়া এয়ারের টিকিট (২৫০ রিঙ্গিত ওয়ান ওয়ে) পাওয়া গেল না। তাই বাধ্য হয়ে গেলাম পুডুরায়া বাস টার্মিনালে। বাস যায় মার্সিং পর্যন্ত। মার্সিং থেকে ফেরী বা স্পীডবোটে তিওমান যাত্রা (এক/দুই ঘন্টা, ৩৫-৪৫ রিঙ্গিত)। রাত সাড়ে দশটার বাসের টিকিট কিনেছিলাম ২৪ রিঙ্গিত দিয়ে। বাসা থেকে বেরোতে গিয়ে দেখি সাড়ে দশটা। বুঝলাম বাস মিস হবে, আর মাশীদের ক্যাচক্যাচানি শুনতে হবে ছয় মাস। গিয়ে দেখি বাস তখনও লোক তুলছে। শেষে ছাড়ল রাত এগারোটায়।

মার্সিং এ পৌছেছি ভোর সাড়ে ছ'টায়। দোকান থেকে তিন রিঙ্গিত দিয়ে নাসি লেমাক (নাসি = ভাত, লেমাক = নারকেলের ফ্যাট) দিয়ে নাস্তা করলাম। নাসি লেমাক মন্দ না, টিপিকাল মালে ডিস। সাদা ভাতের সাথে ডিম সেদ্ধ বা পোচ, অ্যানচভি (ছোটমাছের শুটকি) আর টমেটো, নারকেল দুধ, লালমরিচ আর মসলা দিয়ে তৈরি সাম্বাল - এই হল নাসি লেমাক। মাশীদরা সিঙ্গাপুর থেকে পৌছাবে সকাল এগারোটায়। তাই সাইবার ক্যাফেতে আড্ডা। তিওমানে নেট পাব কিনা জানি না। তবে মনমুগ্দধকর প্রকৃতি দেখার অপেক্ষায় আছি।
(এই টুকু লেখা হয়েছিল মার্সিং-এ বসে)


* * * * * * * * * * * * * * * * * * * *













* * * * * * * * * * * * * * * * * * * *

মাশীদদের জন্য বসে ছিলাম সকাল ছটা থেকে। মার্সিং-এ বাস যেখানে থামে তার নাম আর এন্ড আর প্লাজা। এর পাশেই জেটি। আর এন্ড আর প্লাজা তে সব এজেন্টগুলোর কাউন্টার। হাতে সময় থাকায় সাইবার ক্যাফে খুজে বের করে সুমনদার সাথে গ্যাঁজাতে বসলাম। হঠাৎ মাশীদের এসএমএস। একটা ফোন নামবার দিয়েছে, ওখানে কল করে ফেরীর টিকেট যোগাড় করতে হবে। সাড়ে এগারোটায় ফেরী। ফোন করায় আমাকে বলা হল আর এন্ড আর প্লাজাতে চলে আসতে, ওখান থেকেই টিকেট দেওয়া হবে। আগেই বুকিং দেওয়া ছিল, তাই ঝটপট দুশো আশি রিঙ্গিত দিয়ে চারটা টিকেট কিনে ফেললাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমারা যে ফেরীটায় রওনা দিলাম বিকাল পাঁচটায়, সেটার তিনটায় ছাড়ার কথা ছিল! ঘটনা হল যাদের কাছে বুকিং দেওয়া হয়েছিল তারা কাজটা ঠিক মতো করেনি। ফলে জেটির কাউন্টার থেকে আমাদের না করে দিল। এগারোটার ফেরীতে তাই যাওয়া গেল না। চোটপাট করে টাকা ফেরত নিয়ে আবার টিকেট কাটলাম বিকেল তিনটার ফেরীর জন্য। সেই ফেরী ঘাটে এল সাড়ে চারটায়, ছাড়ল পাঁচটায়!














তিওমান ছোট দ্বীপ। দ্বীপের চারদিকের সৈকতে গড়ে উঠেছে সব জনবসতি। কিন্তু এক সৈকত থেকে আরেক সৈকত বিচ্ছিন্ন। আবার সৈকতভেদে বালুকাবেলার সৌন্দর্যেও অনেক পার্থক্য হয়। তাই তিওমানের ঠিক কোন সৈকতে যাবেন তা আগেই ঠিক করা প্রয়োজন। সোনালী বালু আর স্ফটিক সবুজ পানির জন্য সেরা সৈকত হল সালাং। টেকেক সৈকতও খারাপ না। আমাদের কপাল খারাপ। হোটেল পাওয়া গেল শুধু এয়ার বাতাং (এবিসি বীচ) সৈকতে (সাদামাটা সৈকত)। তিনটে জেটিতে লোক নামানোর পর ফেরী এয়ার বাতাং এর জেটিতে ঠেকে। জেটিতে যখন নামলাম তখন সম্পূর্ন ক্লান্ত-অবসন্ন। সামনে তাকাতেই কিছুটা ক্লান্তি ভুলে গেলাম। সবুজ স্বচ্ছ পানি! পিছে সারি সারি সব শ্যালে। আমরা উঠলাম জোহানস হাউস নামের একটা বাজেট হোটেলে। এসি ওয়ালা শ্যালের ভাড়া রাতপ্রতি আশি রিঙ্গিত। এখান থেকে সমুদ্র দেখা যায় না। বীচটাও পাথুরে আর ময়লা। নাজরী'স বরং ভালো। এদের শ্যালেগুলোর সম্মুখের সৈকত খবুই মনমুগ্ধকর। কিন্তু খরচও বেশী (১৬০ রিঙ্গিত রাতপ্রতি)। জোহান'স এর রেস্তোরাটা মন্দ না। বারবিকিউ করা টুনা আর সাদাভাত দিয়ে ডিনার করতে লাগল ১৭ রিঙ্গিত। টুনা ছাড়াও এখানে ব্যারাকুডা, স্টিংরে, স্কুইড এর বারবিকিউ পাওয়া যায়। নাসি গোরিং আর মি গোরিং (ভাজা নুডুলস) যে পাওয়া যায় সেটা বলাই বাহুল্য। ডিনারের পর বীচে ঘুরতে বের হলাম। সাগরের জলে ফসফরাসের আলোর কথা শুনেছিলাম, এবার সচক্ষে দেখা হল। ঘন্টায় চার রিঙ্গিত দিলে সাইকেল ভাড়া পাওয়া যায়। শখ থাকলে আর ভাড়া নেওয়া হয়নি। কিছদূর হাটার পর আমরা লক্ষ্য করলাম তিওমানে প্রচুর বিড়াল এবং অনেক-কটারই লেজকাটা! প্রতিদিন রাতে ডিনারের সময় মাশীদকে এরা বিরক্ত করে ব্যাপক আনন্দ লাভ করত এবং আমার স্ত্রীও বিড়াল দেখে যারপরনাই সন্ত্রস্ত হতেন।










রোববার সকালে উঠে জানলাম আমরা স্পীডবোট নিয়ে বের হচ্ছি। দিবসের প্রধান কার্যক্রম হবে স্নরকেলিং। ইন্দ্রনীল দশ রিঙ্গিত দিয়ে গিয়ার ভাড়া নিল। আমি তো সাঁতারই জানি না, তাই উৎসাহ দেখালাম না। আমার ধান্দা ছবি তোলা। লো টাইডের জন্য বোট এল সাড়ে এগারোটায়। আমাদের সঙ্গী হল দুই সুইডিশ তরন-তরুনী (মেয়েটার নাম সিসিলিয়া এটা মনে আছে)। লাংকাওয়িতে আইল্যান্ড হপিং এর সময় স্পীডবোটে চড়েছি। সেবার ভয় পেয়েছিলাম, এবার আত্মা কেঁপে উঠল। বিশাল ঢেউ এ পড়ে স্পীড বোট একটু পরপর লাফ দেয়। তারপর যখন পানিতে ধাপ করে পড়ে, আমরা সবাই তখন প্রায় ছিটকে পড়ি পানিতে! জান যায় যায়! ভাগ্যিস লাইফজ্যাকেট পড়া ছিল সবার। প্রায় আধা ঘন্টা যাবার পর বোট থামল সাগরের মাঝে অদ্ভুত একটা যায়গায়। কিছু পাথর জড়ো হয়ে দ্বীপের মতো হয়ে আছে। প্রাকৃতিক না মানুষের গড়া জানিনা, কিন্তু দেখতে অবাক লাগে। সারেং বলল এখানে স্নরকেলিং করতে। ইন্দ্রনীল আর সুয়েড গুলো নেমে গেলে। মাশীদ আর টিনা তখন রুটি ছিড়তে ব্যস্ত মাছকে খাওয়াবে বলে। আমি রেডি হলাম ছবি তুলতে। মাশীদ রুটির টুকরো ছোড়ে আর তা পানি ছুতে না ছুতেই শেষ করে দেয় একদল কালো ডোরাকাটা নীল মাছের দল। এদের দলে একটু পর ভীড়ে গেল কিছু প্যারট ফিস আর হলদে মাছ। হঠাৎ পাশে ভুস করে ইন্দ্রনীল মাথা উঠাল পানি থেকে। জিজ্ঞেস করলাম কেমন, উত্তর দিল অসাধারন। কি যেন হল। আর সামলাতে পারলাম না। আমি সাঁতার পারি না তো কি! লাইফ জ্যাকেট পড়ে, ইন্দ্রনীলের স্নরকেলিং গিয়ার পড়ে ঝাপ দিলাম নীল জলে। জীবনে আগে স্নরকেলিং করিনি, তাই প্যানিকড হয়ে গপগপ করে নোনা পানি গিলে ফেললাম। প্রায় ডুবি আর কি। অনেক কষ্টে সামাল দিয়ে কিছুটা শান্ত হয়ে আবার ডুব দিলাম। এবং পরবর্তী বিশ মিনিট নেশা গ্রস্ত হয়ে গেলাম। আন্ডারওয়াটার ক্যামেরা নাই বলে দেখাতে পারলাম না কি যে অসাধারন আর অপার্থিব সে দৃশ্য। টলটলে নীল পানি, নিচে নানা রঙের কোরাল আর তাতে নীল-হলুদ সব বিচিত্র মাছের খেলা। টিভিতে অনেকবার দেখেছি, নিজ চোখে দেখার আনন্দই আলাদা। ইন্দ্র ডুব সাতার জানত, তাই তার দেখার আনন্দ ছিল আরও গভীর। সে সাঁতরে সাঁতরে ক্লাউন ফিশ ("ফাইনডিং নিমো" এর নিমো) দেখে ফেলল এক ফাঁকে। একঘন্টা পর আমরা এই কোরাল রীফ থেকে আরেকটা বীচে গেলাম। সেখানেও একই ঘটনা। সোনালী বালু আর সবুজ স্বচ্ছ পানি, তাতে বিচিত্র মাছের খেলা। তিনটার দিকে আমরা সালাং গিয়ে লাঞ্চ করলাম। তারপর মাঙ্কি বে হয়ে ঘরে ফেরা। কিন্তু পুরোটা সময়ই মাথায় ঘুরছিল সেই সাগরতলের অপরূপ দৃশ্যের কথা । বেশী সাঁতরে বেড়ানোয় ছবি তোলা হয়েছে কম। কিন্তু স্নরকেলিং এর অভিজ্ঞতাটা তো অসাধারন! তাই প্ল্যান করেছি এরপর রেদাং গিয়ে আবার স্নরকেলিং করব। সাতার শিখতে পারলে ভালো হত, আরও ভালো হত স্কুবা ডাইভিং এর লাইসেন্স থাকলে। যাই হোক, বেশ মজা হল অনেকদিন পর। কিন্তু সন্ধ্যার দিকে সারা গা ব্যথা হয়ে গেল। ডিনার করলাম আগে আগেই। তারপর হাঁটাহাটি চলল মাঝরাত পর্যন্ত।

আজ (৫ই জুন, ২০০৬) সকাল সাড়ে সাতটার ফেরী ধরে এগারোটায় মার্সিং পৌছালাম। সাড়ে এগারোটার বাসে আমি কেএল আর ওরা সিঙ্গাপুর রওনা দিল। শখ ছিল আরও কটা দিন থাকব। সমস্যা হল তিওমান, লাংকাওয়ির মতো অতোটা গোছানো না। তাই আগে থেকে কিছু ঠিক না করা থাকলে মহা ঝামেলায় পড়তে হয়। রেদাং-এ এই সমস্যাটা আরও বেশী। ঝামেলা যাই হোক নেক্সট অ্যাডভেঞ্চার, রেদাং-এ হবে, তাতে সন্দেহ নেই...


(প্রথম প্রকাশঃ http://www.somewhereinblog.net/blog/arupblog/10773 ০৫ ই জুন, ২০০৬ সকাল ১০:৩৪ )

No comments:

Post a Comment

To comment in Bangla, please use Avro Keyboard Interface. Click here for Bangla Installation Guide.

বাংলায় লিখতে অভ্র কিবোর্ড ব্যবহার করুন. বাংলা ইন্সটলেশন গাইড পাবেন এখানে