Sunday, December 7, 2008

ওব্রিগাদো সাও পাওলো - ০২

অনেক গুলো রাজ্য নিয়ে গঠিত ব্রাজিল, সাও পাওলো হল সাও পাওলো রাজ্যের রাজধানী। ব্রাজিলে এটাই সবচে' বড় আর জনবহুল শহর। সাও পাওলো শহরের মানুষদের বলা হয় "পলিস্তানো" আর সাও পাওলোর ডাকনাম হল "সামপা"। ব্রাজিলের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র এই শহর। সাও পাওলো যদি একটা দেশ হতো তবে এর অর্থনীতি হল বিশ্বের ৪৭তম, যা কিনা মিশর আর কুয়েতের উপরে, হাঙ্গেরী বা নিউজিল্যান্ডের সমান আর ইজ্রায়েলের প্রায় ৮৫%! যানজটের দিক থেকেও এই শহর অনেক এগিয়ে, কোথাও যেতে হলে ঘন্টা খানেকের প্রস্তুতি নিয়ে বের হতে হয়। সেই কারনেই এখানে হেলিকপ্টারের ব্যবসা বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। বর্তমানে প্রায় ৪০০ হেলিকপ্টার বছরে ৭০,০০০ হাজারের মতো ফ্লাইট পরিচালনা করছে, উঁচুতলা ভবনের ছাদে প্রায়শই তাই দেখা যায় ছোট ছোট হেলিপ্যাড। এখানকার আবহাওয়া বড় পাগলাটে, এই ঠান্ডা তো সেই গরম। যাবার আগে দেখেছিলাম ১৫ ডিগ্রি, গিয়ে পেলাম ২২! লোকে আবহাওয়ার পূর্বাভাষে তাই একদমই পাত্তা দেয়না (সাও পাওলো নিয়ে খুঁটিনাটি এখানে, মূল গল্পে ফিরে যাওয়া যাক বরং)

আমাদের রাখা হয়ে ছিল শহরের প্রাণকেন্দ্র অ্যাভিনিউ পলিস্তার পাশেই, হোটেলের নাম গোল্ডেন টিউলিপ। অ্যাভিনিউ পলিস্তা টানা লম্বা এক রাজপথ, তারপাশেই শহরের যতো বড় বড় বানিজ্যিক ভবন আর দোকানপাট, রাজপথের সমান্তরাল বয়ে গেছে অনেকগুলো বড় গলির মতো রাস্তা, তাদের একটা হল অ্যালামিদা সান্তোস, গোল্ডেন টিউলিপ সেখানটাতেই। ওয়ার্কশপ শুরু ২৪শে, দুপুর দুটোয়। এই ফাঁকে শহরটা ঘুরে দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। রাস্তায় নামতেই পছন্দ হয়ে গেল, বড় হয়েছি এলিফেন্ট রোডে। তাই দোকানপাট রাস্তাঘাটের প্রতি একটা টান আছে, মন্ট্রিয়লের সেন্ট ক্যাথরিন স্ট্রিটে ঘুরে বেড়াতাম এই কারনে। অনেকেই বলেছিল আইনশৃঙ্খলা ভালো নয় ব্রাজিলে। সেই কথাটা এমনভাবে মাথায় গেঁথে গেল যে শান্তিমতো ছবি তুলতে পারলাম না, ফন্দি করলাম, খোলা ক্যামেরা বুকে ঝুলিয়ে ঘুরবো, কিছু দেখলে শাটার টিপে দেব চুপচাপ, যা ওঠে উঠুক। এই চোরাই পদ্ধতি ছবি তোলার ফল হল অদ্ভুত, সব ছবি বাঁকা আর উল্টোপাল্টা কমপোজিশন। আবার বাঁকা পারস্পেকটিভের জন্য কিছুটা শৈল্পিকও লাগে।

শখ ছিল ইবিরাপুয়েরা পার্কে যাব, সঙ্গীত ভাই ঘ্যানঘ্যান করাতে তা বাদ দিলাম। মেজাজ এতো চড়ে গেল যে ঠিক করলাম লাঞ্চ আলাদা করবো। শালাকে রুমে পাঠিয়ে আবার বের হলাম, ক্ষিদে ভালোই পেয়েছে। রাস্তার চৌমাথায় একটা রেঁস্তরা দেখা গেল, ঝটপট তাতেই ঢুকে গেলাম। মেনু দেখে পুরো জব্দ, পর্তুগীজে লেখা। ওয়েটার এলো অর্ডার নিতে, মহা বিপদ! চোখ পড়ল দেয়ালে টানানো খাবারের ছবিতে। ব্যাটাকে টেনে নিয়ে গেলাম, আঙুল দিয়ে দেখালাম, ইহাই খাইতে চাই! সেই "ইহা"টা দেখতে ছিল একদম আলু দিয়ে ঝাল গরুর মাংস আর ভাতের মতো। ব্রাজিলে এমন জিনিস পাওয়া যাবে আশা করিনি। মুড়িওয়ালা প্রায়ই ঘ্যানঘ্যান করে ব্রাজিলের খাবার ভালো না। ভাবলাম, ব্যাটা খোঁজখবর রাখে না ঠিকমতো। খেতে গিয়ে দেখি গোস্তে ঝাল নেই, লবনও কম। কি আর করা, সেটাই খেলাম, বিল এল সাড়ে দশ হ্রিয়াইস (সিঙ্গুলার Real, প্লুরাল Reais), প্রায় সোয়া চার মার্কিন ডলারের মতো। ভালোই সস্তা, পরে টের পেলাম এটা গরিবানা হোটেল। একটু ভালো কোথাও খেতে গেলেই বিশ/পঁচিশ হ্রিয়াইস খরচ হয়ে যায়। আর ফাইন ডাইনিং হল তো এক ধাক্কায় একশ ছাড়িয়ে যায়!

দুপুরে ওয়ার্কশপ শুরু হল। ব্রিটিশ সাহেবরা কিভাবে দুনিয়া দখল করেছিল সেটা খানিকটা টের পেলাম। এখানে এসেই এরা পর্তুগীজ শিখে নিয়েছে মাস তিনেকের মধ্যে। বাকিদেরও ঠ্যালা দেওয়া হয়েছে পর্তুগীজ শেখার জন্য। ফলে আমাদের মুড়িওয়ালাও এখন কাজ চালানোর মতো পর্তুগীজ জানে। যাই হোক, এখানে যে প্রজেক্টে আসা তা বছর দুয়েক আগে শুরু হয়েছিল। পরে বন্ধ হয়ে যায়, কদিন আগে আবার শুরু হয়েছে। সেই একই গল্প.. ঘ্যানর ঘ্যানর..। ৫টা নাগাদ আর পারি না, শরীর ভেঙ্গে পড়ে, জেটল্যাগ! হবেই তো, দশ ঘন্টার তফাৎ!!

ভাবলাম দিনশেষে ঘরে গিয়ে ঘুমাবো, শুনি রাতে মহাশয়রা যাবেন মাংস খেতে। ব্রাজিলের বারবিকিউ এর নাম শুনেছি, লোভে পড়ে শ্রান্ত শরীরে হাজিরা দিলাম। দেখি জনগন কাইপিরিনিয়া গিলছে। কাইপিরিনিয়া হল ব্রাজিলের জাতীয় ককটেইল, লেবুর রস, চিনি আর কাশাসা দিয়ে তৈরি হয় এই মাল। আমি মার্গারিটার পাংখা, তাই নিলাম গভীরাগ্রহে। লোক সাবধান করলো, বাপুহে কম খা! কে শোনে কার কথা, ৪টা খাবার পর মাথা গেল আউলে। ভাগ্যিস রুম পর্যন্ত হেটে ফিরতে পেরেছি। এর পর আরো আটদিন ছিলাম, অ্যালকোহলের ধারেপাশে যাইনি, ক্যারিয়ার টিফিন ক্যারিয়ার বানাবার কোন দরকার নাই মামা!

পরদিন সেশন শুরু হল সাড়ে আটটায়, থ্যাংক্স টু জেটল্যাগ, পাড় মাতাল হবার পরও ঠিক ভোর পাঁচটায় ঘুম ভেঙ্গে গেল। অসহ্য যন্ত্রনা সারাগায়ে, ডান পায়ের হাঁটুতে ব্যথা, সাথে ভয়াবহ রকম অ্যাসিডিটি! জান যায় যায় প্রায়। কোনমতে দিন শেষ করে বের হলাম মুড়িওয়ালার সাথে। মুড়িওয়ালা আমার একবছরের বড়, গ্রেডেও এক গ্রেড উপরে। কিন্তু তার সাথে যাবতীয় মস্করা আর তামাশা করি নির্দ্বিধায়। সেও কিঞ্চিত খুশি দেশের মানুষ পেয়ে। সেই আনন্দে সে আমাদের নিয়ে গেল চুরাস্কারিয়াতে। লাতিন আমেরিকায় চুরাস্কো মানে হল গ্রীল মাংস, আর যে রেঁস্তরায় এজিনিস সার্ভ করে তাকে বলে চুরাস্কারিয়া।

চুরাস্কো লাতিন আমেরিকার প্রায় সবদেশেই চালু আছে, তফাৎ হল মাংসের কাট আর প্রিপারেশনে। আমরা যেখানে গেলাম সেই দোকানের নাম ফোগো দে শাও। ট্যাক্সিওয়ালা তো দাবী করেই বসলো, এটা নাকি মাইকেল শুমাখারের পছন্দের জায়গাগুলোর একটা।

ফোগো দে শাও খানিকটা বুফের মতো। জনপ্রতি নির্দিষ্ট অংক দিয়ে ঢুকতে হয়। মনভরে সালাদ নিয়ে টেবিলে বসবেন। বেয়ারা এসে পানীয় আর একটা কাগজের চাকতি দিয়ে যাবে। একটা দিক সবুজ, লেখা "আরো চাই", আরেকটা দিক লাল, লেখা "না, ধন্যবাদ"। যতোক্ষন সবুজ দিকটা খুলে রাখবেন, বেয়ারা একটু পর পর এসে নানারকম শিকে গাঁথা কাবাব, আপনার পছন্দমতো অংশ (রেয়ার, মিডিয়াম বা ওয়েলডান) থেকে কেটে দিয়ে যাবে। পেট ভরে গেলে লাল দিকে মেলে রাখুন। কেউ বিরক্ত করবে না।

স্কিউয়ারে গেঁথে এরা মাংস স্লোরোস্ট করতে থাকে। মসলা বলতে শুধু লবন। যারা রেয়ার/মিডিয়াম রেয়ার পছন্দ করেন তাদের বেশ ভালো লাগবে, সন্দেহ নেই। ব্রাজিলে ফিলে মিনিও আর রাম্প স্টেক বেশী জনপ্রিয়, কুঁজের মাংসও এদের বেশ পছন্দ। ফোগো দে শাও-এ খাওয়াতে বেচারা মুড়িওয়ালার প্রায় ২৮০ হ্রিয়াইস খসে গেল। স্বীকার করতেই হবে, ভিন্ন পরিবেশনাই হোক আর নতুন ঘরানার খাবারই হোক, ডিনারটা ছিল মনে রাখার মতো।

এর পরদিন অফিস থেকে নিয়ে গেলে ফিগুয়েরা রুবাইয়াতে। বিখ্যাত রেঁস্তরা, ১৯০ হ্রিয়াইস মাথাপিছু, খাবারও সেইরকম। মাংসখোরদের ভীষন প্রিয় জায়গা বোঝাই যায়। আমার চোখ ছিল অবশ্য গ্রীলড সার্ডিনের দিকে। এই জিনিসটা এরা পেয়েছে পর্তুগীজদের কাছ থেকে। টাটকা সার্ডিন আস্ত, অলিভওয়েল আর লবন মাখিয়ে চড়িয়ে দিয়েছে গ্রিলে, গ্রিল থেকে যা সুগন্ধ বের হচ্ছিল তা বলার মতো না। যারা ইলিশের গন্ধ শুঁকে পাগল হন, তারা বিষয়টা কল্পনা করতে পারবেন। সুযোগ পেলে এই স্টাইলে ইলিশ গ্রিল করে দেখতে হবে। রুবাইয়াতের আরেকটা খাবার খুব বিখ্যাত, গ্রিলড বাচ্চা শূকর। ২০/৩০ দিন বয়সের আস্ত শূকর ছানা গ্রিল করা হয় মহা আয়োজন করে। শখ ছিল, খাওয়া হল না, এই দুঃখ কোথায় রাখি?

তবে ব্রাজিলে অনেক পুরোনো একটা শখ মিটে গেল। স্টেক তাতার (বা স্টেক টার্টার) হল তাতারদের খাবার । মধ্যএশিয়ার তাতার জাতির হাতে সময় ছিল না রেঁধে খাবার, তাই কাঁচা মাংস মসলাপাতি মিশিয়ে ঘোড়ার স্যাড্ল এর নীচে রেখে তারা যাত্রা শুরু করতো। গন্তব্যে পৌছাতে পৌছাতে মাংস নরম হয়ে খাবার উপযোগী হয়ে যেত। কাঁচা মাংসের এই খাবারই পরে ইউরোপে বেশ জনপ্রিয় হয়। কাঁচা মাংসে সংক্রমনের ভয় থাকার কারনে এটি খুব সহজলভ্য খাবার নয়। ফুড চ্যানেলে আগেই দেখেছিলাম, কিন্তু পাব কই, নিজে বানাতেও সাহস হয় না। তো সেদিন, লাঞ্চে দেখি রব ডিক্সন প্লেট হাতে শেফের সামনে দাড়িয়ে, সামনে বাটিতে কুচানো কাঁচা মাংস।

"ইউ আর হ্যাভিং র' মিট?"
"ইয়া, ইটস কলড স্টেক টাটার", রব হাসতে হাসতে বলে।
বুড্ঢা রব ডিক্সন খাবে, আর আমি কেমনে বাদ থাকি? নিলাম আমিও। মাংস, কাঁচা ডিম, পেয়াজ, কেপারর্স আরো হাবিজাবি দিয়ে শেফ অনেকক্ষন ঘুটা দিলো। তারপর তেকোনা ছোট ছোট টোস্ট দিয়ে প্লেটে সাজিয়ে দিল। সত্যি বলতে শুরুতে খানিকটা অস্বস্তি হয়েছিল, তারপরেও সাহস করে মুখে দেই। টোস্ট দিয়ে খেতে ভালোই লাগছিল। এরকম আরেকটা জবরদস্ত খাবার আছে, যাকে বলে সেভিচে। মনে ছিল না, না হলে এজিনিসও একবার খেয়ে দেখা দরকার...

যারা ভাত পছন্দ করেন তাদের জন্য ব্রাজিল শান্তির দেশ, এরা গভীরাগ্রহে ভাত খায়, সাথে খানিকটা তেল দিয়ে রাঁধে বলে হালকা পোলাও পোলাও ভাব চলে আসে। ভাতের সাথে বীনের তরকারি থাকবে অবধারিত ভাবে। এদেশের মানুষ যদি একটু ঝাল-মসলা খাওয়া শিখতো তাহলে চাইনীজ, ইন্ডিয়ানের পাশাপাশি ব্রাজিলিয়ান কুইজিনও জনপ্রিয় হতো সন্দেহ নেই। আমাদের মুড়িওয়ালা এখনও রাঁধতে শিখেনি। সে দোকান থেকে আনিয়ে খায় বলে মাসে প্রায় ৮০০ হ্রিয়াইস খসে যায় পকেট থেকে। বাবা-মা-দের উচিত লেখা-পড়া-নাচ-গানের সাথে পোলাপানদের রান্নাবাটি শেখানো। প্রবাসী সচলরা আমার সাথে একশতভাগ একমত হবে সন্দেহ নেই চোখ টিপি

এই পর্ব শেষ করি ছবি দিয়ে। সামনের পর্বে গল্পের মোড়ক আরেকটু খোলা যাবে.. (চলবে)

Sao Paulo Skyline
হোটেল থেকে সাও পাওলো



Avenue Paulista
অ্যাভেনিউ পলিস্তা

Alternative Transport
বিল্ডিং এর ছাদে হেলিপ্যাড, তাতে হেলিপক্ষী!

Churrascaria Grill
ফোগো দে শাও এর মাংসভোজ

Sao Paulo's "Thelagaari"
ব্রাজিলের ঠেলাওয়ালা







Promoting the Oldest Trade
সঙ্গিনী চাই? বিশ বছরে বয়সী সেনসুয়াল রমনী?

IMG_0564
অ্যাভিনিউ পলিস্তায় ক্রিসমাসের যাত্রা!

IMG_0621
পাগল

Uma real, por favor..
ভিক্ষা করে কিশোর

Monument to the Flags
ইবিরাপুয়েরা পার্কের ভাস্কর্য (বাংলাদেশে তো ক'দিন পরে এসব দেখা যাবে না)

Saving My Car's Ass
গাড়ি টানতে নয়, গুঁতো থেকে পাছা বাচাতে এই হুক

No comments:

Post a Comment

To comment in Bangla, please use Avro Keyboard Interface. Click here for Bangla Installation Guide.

বাংলায় লিখতে অভ্র কিবোর্ড ব্যবহার করুন. বাংলা ইন্সটলেশন গাইড পাবেন এখানে