Sunday, December 7, 2008

ওব্রিগাদো সাও পাওলো - ০৩

শুক্রবারে যখন ওয়ার্কশপ শেষ হল তখন মেজাজ চড়ে গেছে। অনেকক্ষন বিছানায় পড়ে থাকলাম। বিলিতি সাহেব জানিয়েছেন ওয়ার্ক পারমিটের জন্য দেড়-দুমাস সময় লাগলে আমাকে প্রজেক্টে নেবার মানে হয়। এখানেও সবুজ পাসপোর্টের দোষ নেই, ওয়ার্ক পারমিট জিনিসটাই ঝামেলার, সেটা প্রস্তুত হতে এমনই সময় লাগে। হাতে সময় না রেখে কাউকে চট করে "ওয়ার্ক পারমিট" দিয়ে আনাবার ধান্দাটাই ভুল। মুস্কিল হল লাট সাহেব আর আম্রিকানদের জন্য এইসব নিয়ম অনেকটাই শিথীল, ফলে তারা জটিলতার হিসাবগুলো ঠিকমতো ধরতে পারেন না, কি আর করা...

বিছানা থেকে উঠে দেখি তিনটা বাজে, মন খারাপ হলে ঘর থেকে বের হওয়া হল উত্তম ঔষধ। অচেনা দেশে কোথায় যাব? শেষে মনে হল আর্ট মিউজিয়ামে যাই, ক্রিসকে সাথে নিলে ঠিকমতো দেখা যাবেনা, গেলে শালাকে বাদ দিয়ে যাওয়াই ভালো।

মিউজিয়াম এভিনিউ পলিস্তায়, ট্যাক্সিভাড়া তেমন হবার কথা না। একটা চিরকুটে নামটা লিখে বের হলাম ট্যাক্সি নিতে। সাও পাওলোর রাস্তার মোড়ে মোড়ে ট্যাক্সি পাওয়া যায়। কেউ ভাড়া নিয়ে হাঙ্কিপাঙ্কি করে না, মিটারই মহেশ্বর! ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে গিয়ে চিরকুট দেখাই। উঠব যখন, তখন শুনে "অরূপ! অরূপ!" বলে ডাক। রাস্তার ওধারে ক্রিস আর আলফ্রেড সাভারিআপ্পান। আলফ্রেড এসেছে আগে, মুড়িওয়ালার মতো সেও সেকন্ডেড এখানে। ডাকছিলো সেই।

মহাবিরক্ত হয়ে গেলাম। শালারা একটুও শান্তি দিবে না! আলফ্রেড হল রমনীখেকো। তারা কুকাহিনী শুনলে লক্ষী ছেলেরাও বদ হয়ে যাবে, ব্রাজিল এসেই সে সুদর্শিনী সঙ্গিনী জুটিয়ে ফেলেছে। সে দেখি মিটিমিটি করে হাসছে আমার দিকে তাকিয়ে..
"ইফ ইউ ওয়ান্টেড টু গো টু আ রেড লাইট সিটি হোয়াই ডিডন্ট ইউ টে মি লাস্ট নাইট? দিজ প্লেসেস আর রিস্কি, ইউ নো... লেট মি সি দ্য নেম", বলেই খস করে সে আমার হাত থেকে চিরকুটটা খসিয়ে নেয়। আমি বলি, "কয় কি মমিনের বাপ!"

চিরকুট পড়ে বেচারার বিরক্তির সীমা থাকে না। ব্রাজিলে লোক আসে ফুর্তি করতে, এই ছাগল যাবে মিউজিয়ামে! আমি নাছোড়বান্দা, মিউজিয়ামে না গেলে শহর ধরে হাটতে রাজী আছি, কিন্তু ক্লাবে যাব না!

আলফ্রেড রাজী হয়ে গেল, তিনজনে পলিস্তার রাজপথ ধরে হাটা শুরু করলাম।

এই ফাঁকে কিছু পরিসংখ্যান টানা যাক। ব্রাজিলের মানুষের প্রায় অর্ধেকই ব্রাংকা (সাদা, ইউরোপিয়ান), ৪২% পারডো বা মিশ্রজাত (ব্রাউন), ৭% প্রাটো (কালো) আর সামান্য কিছু এশিয়ান (মূলত জাপানী) ও আমেরিন্ডিয়ান। দাসপ্রথা বিলুপ্তির পরে এখানকার ক্ষমতাধরেরা খানিকটা ভয় পেয়ে যায়, তাই ইমিগ্রেশনের দরজা খুলে দিয়ে বিপুল পরিমান ইউরোপিয়ানকে ডেকে আনা হয় ব্রাজিলে। ইতালি, জাপান আর মিডল ইস্টের বাইরে সবচে' বেশী ইতালিয়ান, জাপানি আর আরবদের দেখা মিলবে এই দেশে। রেসিয়াল প্রবলেম নিয়ে প্রশ্ন করলাম অনেকেই, সবাই বলল এখানে এসব সমস্যা নেই। পরিসংখ্যান বলে অন্যকথা, অশিক্ষা, বেকারত্ব, শিশুমৃত্যূর হার কালো আর পারডোদের বেশী। অফিস আর হোটেলের সব ভালো পজিশনে সাদাদেরই রাজত্ব, নাম দেখেই বোঝা যায় এরা ইউরোপিয়ান রক্তের মানুষ।

এভিনিউ পলিস্টায় হাটতে গিয়ে সাদা আর জাপানি মানুষই বেশী চোখে পড়ল (মুর্শেদের জন্য লাটিনা চিকিতা খুঁজে পেলামই না শেষ পর্যন্ত)। বুকে কাছে ক্যামেরা ধরে ছবি তুলেই যাচ্ছি। আলফ্রেড সাবধান করেদিল ছিনতাই হতে পারে। এতোটা সাবধান করার দরকার ছিল না, কারন পলিস্তা শানদার এরিয়া, পুলিশ-পাহারা কম না, হুদাই ভয় ধরিয়ে ব্যাটা আমার ছবি তোলার বারোটা বাজিয়ে দিল।

অনেক দিন পর এরকম চমৎকার রাস্তা ধরে হাটতে ভালো লাগছিল। দুপাশে নানারকম দোকান। বই এর দোকানে থামলাম, সেখানে প্লেবয় সাজানো থরে থরে, তার ঠিক নিচেই আবার কাফকা। সব পর্তুগীজে, তাই কেনা হল না কিছুই।

তাপমাত্রা ২১ ডিগ্রি, সাথে ফুরফুরে বাতাস। মেজাজ কখন ভালো হয়ে গেছে টের পাইনি। আলফ্রেড খেতে নিয়ে গেল এক রেস্তরায়। ব্রাজিলে খাবার মানেই বিশাল আয়োজন, খেয়ে শেষ করা যায় না। তাই আমরা পাস্টেল খাব ঠিক করলাম।
পাস্টেলকে চারকোনা কিমাপুরী বললে ভুল হবে না (আহা! কতোদিন পুরী খাই না!)। কিমায় ঝালমসলা কম, কিন্তু খেতে চমৎকার।

পাস্টেল পর্ব শেষ হলে আলফ্রেড গেল গার্লফ্রেন্ডের খোঁজে, আমি আর ক্রিস গান ফিরতি পথে হাটা দিলাম। মালেশিয়ায় থেকে থেকে শীত কি জিনিস মনে থাকে না। সাও পাওলোর মিষ্টি ঠান্ডায় বারো হাজার মাইল দূরে আমার মনে পড়তে থাকে ধানমন্ডির রাস্তা, এলিফেন্ট রোডের ভীড় আর নীলক্ষেতের তেহারী। আমাদের কি বিচিত্র মন। আমরা যা মনে প্রাণে ত্যাগ করে আসি, সেসবই হৃদয়ের গভীরে পাকাপোক্ত স্থান করে নেয়।

হোটেলে ফিরতে গিয়ে সন্ধ্যা হয়ে যায়। শানদার হোটেল বলে লাইভ মিউজিক আছে। লবিতে বসি, মুড়িওয়ালা মেক্সিকান খাওয়াতে নেবে রাতে। অপেক্ষা তার জন্য তাই। চামড়ামোড়া সোফায় গা এলিয়ে দেই, হঠাৎ কানে একটা চেনাসুর বাজে..
"Tall and tan and young and lovely
The girl from Ipanema goes walking
And when she passes, each one she passes goes - ah"

এই গানটা শুনেছিলাম সিনাত্রা সিডিতে, নাম দ্য গার্ল ফ্রম ইপানেমা। ইপানেমা, রিও ডে জেনেইরোর বিখ্যাত সৈকত।

The Girl from Ipanema
ইপানেমার মেয়ে এলোইসা (যৌবনে)

ইপানেমা সৈকতের ভেলোসো বারে বসে, গীতিকার টনি জোবিম মিউজিক্যালের জন্য গানের কাজ করতেন। আর প্রতিদিন এলোইসা পিন্টো নামের মেয়েটি হেটে যেত বারের সন্মুখের পথ ধরে। এলোইসাকে দেখেই একদিন লিখে ফেলেন এই গানটি। গানটি পরে দুনিয়া জুড়ে খ্যাতি পায়। সিনাত্রা, ন্যাট কিং কোল, অ্যান্ডি উইলিয়ামস, ম্যাডোনার মতো নামজাদা অনেক শিল্পী গাইতে থাকেন গানটি। এলোইসা হয়ে ওঠেন ব্রাজিলের আইকন। যশকে ভর করে মহিলা দুপয়সা করে নিতে ভুলে যাননি, সুযোগ পেয়ে প্লেবয়ের প্রচ্ছদেও জায়গা করে নেন।

ইউটিউবের কল্যানে শুনুন "দ্য গার্ল ফ্রম ইপানেমা", গাইছেন জোবিম ও অ্যান্ডি উইলিয়ামস্:

শখ ছিল রিও যাবো। খুব দূরেও না জায়গাটা। আনন্দের শহরটাকে দেখব না তা কি করে হয়। কিন্তু সব শখ পূরন হয় না। নীরবে রিও যাবার পরিকল্পনাটা বাতিল হয়ে যায়। একটু পরে মুড়িওয়ালা আসে। টল-এন-টেন্ডার-ইয়াং-এন-লাভলি শিস বাজাতে বাজাতে পা বাড়াই ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের দিকে..

No comments:

Post a Comment

To comment in Bangla, please use Avro Keyboard Interface. Click here for Bangla Installation Guide.

বাংলায় লিখতে অভ্র কিবোর্ড ব্যবহার করুন. বাংলা ইন্সটলেশন গাইড পাবেন এখানে