Friday, December 21, 2007

ঢাকার চিঠি - ০২

ঢাকায় মদ্যপান নিয়ে আমার প্রথম অভিজ্ঞতাটা ভুলবার না। শহরের প্রাণকেন্দ্রে কোন ঝামেলা ছাড়াই যে নিষিদ্ধ এই পানীয় পাওয়া যায় সেটা জেনেছি ইস্টার্ন প্লাজার পাশে র "শ্যালে"তে গিয়ে। সুমন ভাই (পারভেজ সাজ্জাদ) একদিন ধরে নিয়ে গেলেন, ভোদকা খেতে গিয়ে দেখা হল প্রয়াত সঞ্জীব চৌধুরীর সাথে, দলছুট তখন কেবল জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে। হাতে গোনা চার পাঁচবার গেছি শ্যালে আর পিকক-এ। প্রতিবারই একটা ধরা খাবার ভয় কাজ করতো। গতবার যখন ঢাকা এলাম তখন পিয়াল ভাই নিয়ে গেলেন সাকুরাতে (মার্গারিটার প্রতি বাংলার জবাব ভোদকালাইম খেয়ে ব্যাপক আনন্দ পেয়েছিলাম)। এবার উত্তরায় এক বাড়িতে গিয়ে দেখি হোমডিলিভারীতে মদ পাওয়া যাচ্ছে, গৃহকর্তা সেলফোন ডায়াল করলেন, ওপাশ থেকে জানিয়ে দিল কি-আছে,কতো-দর.. গৃহকর্তা খানিক ভেবে অর্ডার দিলেন, মিনিট বিশেকের মাঝেই একটা গিলবি সাহেবের জিনের বোতল পৌছে দিলেন কেউ একজন। এই ঘটনাটা হয়তো আগেও ঘটতো, তবে এবারই যেহেতু প্রথম জানা হল, সে হিসেবে উল্ল্যেখ করাটা মনে হয় ভালো..

কোজি কর্নারে
কোজি কর্নারে


কাল সকালে বাবা বললেন চল, চুল কেটে আসি। আমাদের বাসায় চুল কাটা মানে কদমছাট করা। এর বাইরে একটু কায়দা করে কাটা যে সম্ভব সেটা কারো ধারনায় আসে না। যা হোক, নাপিতের দোকান বাড়ির পাশেই, কোজি কর্নার নাম। কোজি কর্নারে শুধু চুল কাটাই হয়না, চাইলে ফেসিয়ালও করে ফেলা যেতে পারে। প্রচুর কায়দা এদের চুল কাটা নিয়ে, বিদেশী স্টাইল ভালোই নকল করেছে। চুল কাটার এক পর্যায়ে আমার মুখেও ক্রীমটিম মেখে দলাই মালাই শুরু করে দিলেন নাপিত। গালে পুরুষ হাতের দলাই মলাই বিষয়টা ঠিক উপভোগ করা যায় না। আমি ঠোঁট চেপে অপেক্ষা করতে থাকি করে যন্ত্রনার শেষ হবে। সব মিলিয়ে খরচ হল ১৫০টাকা। কেএল-এ সবচে' ফকিরি হালে চুল কাটতেই লাগে ২০০টাকা, মাদাম উইনি লু হাতে কেঁচি ধরলে তো কথাই নাই, ৭০০০টাকা গন উইথ দ্য উইন্ড...

আনিলার অ্যালবাম
আনিলার অ্যালবাম


চুল কেটে গেলাম সিডি কিনতে। জানেমান আনিলার নতুন অ্যালবামটা বের হয়েছে। অর্থহীনের সুমনের সাথে । "গাইবনা" শুনে আমি ফিদা.. এই মেয়েটা গান গাইলে চায়ে চিনি লাগে না.. মুস্কিল হল পুরো অ্যালবামে একটা মাত্র গান ভালো হওয়াটা ঠিক সুলক্ষন না.. এনিওয়ে, আনিলা ইজ আনিলা..

হেলভেশিয়ার ব্রোস্ট
হেলভেশিয়ার ব্রোস্ট


বাড়ি ফিরতে গিয়ে চোখে পড়ল হেলভেশিয়া। একটা সময় মাশীদ আর আমি হরহামেশা আসতাম। ব্রোস্ট খেতে কেমন লাগে সেটা মনে করতে পারলাম না। তাই ঢুকেই পড়লাম। সিঙ্গলে ব্রোস্ট ১০০ থেকে বেড়ে ১৫০টাকায় গেছে। পেপসির দাম আলাদা। আমি দাম দিতে গিয়ে যখন বিশেষ উৎফুল্ল (ক্রেডিট কার্ড অ্যাক্সেপ্ট করেছে!!) তখন পাশের হরিননয়না তরুনীটি পূর্ন সফলতায় আমার পায়ে সাওয়ার ক্রীম ফেলে দিলেন। তারপর কিছুইহয়নি এমনভাব করে গল্প করতে থাকলেন সঙ্গিনীর সাথে। রূপ আর ভব্যতাহীনতা কি সমানুপাতিক হারে বাড়ে?

ব্রোস্ট খেতে গিয়ে আমি বহু চেষ্টা করেও মনে করতে পারলাম না কেন এই জিনিসটাকে গলধকরনের জন্য মুখিয়ে থাকতাম। সময় বড় নিষ্ঠুর, সব কিছু ফিকে করে দেয় সে..

নিউমার্কেট - নীলক্ষেত
নিউমার্কেট - নীলক্ষেত


বিকেলে হাটতে হাটতে গেলাম নিউমার্কেট। সেন্ট ক্যাথরিন ভালো লাগার পিছনের আমার একটা ব্যাখ্যা ছিল। মনে হল ব্যাখ্যাটা ভুল না। নিউমার্কটে সেই একই ভীড়। তবে বুক ভিউ আর সব ডাকসাঁইটে দোকানগুলোর জৌলুস হারিয়ে গেছে। এখন কি বইয়ের কদর নেই?

আমি দুনিয়ার সব দেশেই আমার ট্রেডমার্ক পোষাকে বেড়াতে বের হয়েছি। তাই ঢাকায় খাকি শর্টস আর টি-শার্ট পড়াটা বাদ রাখার মানে হয় না। কিন্তু কে জান্তো সপুত্রক মায়েরা আমার এ বেশ দেখে মুখ টিপে হাসবে.. সিস্টার সাম্ভালকে!..

হাটতে হাটতে এলিফেন্ট রোড, ২৮৮ আর ২৭৮/১। এই দুটো বাড়িতেই আমার শৈশব আর কৈশোর কেটেছে। প্রতিবার দেশে আসলেই এক পলক দেখতে আসি। ২৮৮-র গলিটা আরো ছোট হয়েছে, গেট বসেছে গলির মাথায়। লোকে গাড়ি ঢোকায় কেমন করে কে জানে! এই বাড়িটার প্রাণ থাকলে নিশ্চয়ই খুশি হতো। আমি কথোপকথনটা কল্পনা করি..
-"স্লামালিকুম অপু ভাই (ভাই শব্দটা নিয়ে সংশয় আছে, বাড়ির বয়স আমার চেয়ে বেশী, তার কি ভাই ডাকা মানায়?)
- "আররে ২৮৮, কি খবর? গায়ে এতো শ্যাওলা কেন? হক সাহেবের কি সমস্যা?
- "এই তো, আছি ভালোই। স্যার ভালো নাই, ছোটআপা মরার পর থেকে শরীর খুব খারাপ"


২৮৮ এলিফেন্ট রোড
২৮৮ এলিফেন্ট রোড

অজান্তে জলি আপার প্রসঙ্গটা চলে আসে। আমি বিশেষ অস্বস্তি নিয়ে প্রসঙ্গান্তর করতে চেষ্টা করি


২৭৮ এলিফেন্ট রোড
২৭৮ এলিফেন্ট রোড


২৭৮ এর নতুন নাম হয়েছে, চন্দ্রমল্লিকা। ২৭৮ এর পাশে মেজর সাহেবের বাড়িটা খুঁজে পাইনা। তার বদলে টিনার বেড়া, গায়ে লেখা চাঁদনী ডমইনো। আমরা চলে যাবার অনেক দিন পর চাঁদনী আপাও মারা যান ক্যান্সারে। মেজর সাহেবের বাসার গ্যারেজ ছিল আমারদের প্রিয় খেলার যায়গা। হুমম.. আমি জোরে হাটি, কি দরকার স্মৃতি ঘেঁটে কষ্ট তুলে আনার ।

রাতে লুনা আপির শোধবোধ দাওয়াত ছিল। কজমো লাউঞ্জে খাওয়াবেন। মাসুদ ভাই শুনেই বলেছিলেন ওখানে আমাকে মানায় না। সাতমসজিদের এই লাউঞ্জ ঢাকার তুলনা অনেক এগিয়ে। প্রতি বৃহস্পতিবার গানাবাজনাও হয়। পয়সা দিলে মিউজিক বা ভিডিও ছেড়ে দেবে। মেনুর কোনায় লেখা PDA নিষিদ্ধ। পরে জানলাম PDA মানে Public Demonstration of Affection. আগে নাকি স্মোকিং রুমে ভালোই আদর সোহাগ চলতো। তাই এই আইন। কজমোর খাবার আহামরি না, যতোটা এখানে হাজিরা দেওয়াটা। কফি ওয়ার্ল্ডেও যেতে হবে। সেখানেও নাকি দেখার আছে অনেক

আমাদের জ্যামিতিক পশু
আমাদের জ্যামিতিক পশু


আজকে সকালে আম্মা একটা জ্যামিতিক প্রাণী কিনেই ফেলল । হাসিলের খরচ বাঁচাতে ধানমন্ডির রাস্তায় ছাগলের পাল নিয়ে বের হয় ব্যাপারীরা। খরগোশ সাইজের এই ছাগলটার দাম ৩৫০০! রাস্তায় একটা বাছুর দেখলাম যার দাম দশ হাজার। যেটাকে গরু গরু বলা যায় তার দাম সাতাশ হাজার.. দিনকাল মোটেও ভালো না..


বসুন্ধরা সিটিবসুন্ধরা সিটি
বিকেলে গেলাম বসুন্ধরা সিটি মলে। লেটেস্ট মডেলের সেলফোনে ভরা সব দোকান। প্রচুর মানুষ যে কাঁচা পয়সা নিয়ে ঘোরে সেটা বোঝা যায়..

নকিয়ার রোডশো
নকিয়ার রোডশো


নকিয়ার রোড শো হচ্ছিল। টাইট টিশার্ট পড়া অ্যাটেডেন্টকে দেখেও কেন লোকে ভীড় জমাচ্ছিলো না সেটা একটা রহস্য।


সিডি/ডিভিডির ফ্লোরে চমক অপেক্ষা করছিল। তিন হুজুর প্লেস্টেশনে ফুটবল খেলায় নিমগ্ন। ওয়াও! আরেকটু আগাতেই দেখি এক দোকানে একটা ফরাসী মুভি নাম, Baise Moi, ইংরেজীতে Fuck Me। কুখ্যাত যৌনউদ্দীপক ছবি হিসেবে সারা দুনিয়া ব্যাপী সমালোচিত এই সিনেমার সরবরাহ ঢাকায় দেখে আমি যারপরনাই চিন্তিত। যাবার আগে দেখেছি লোকে ক্যানিবাল হলোকাস্ট দেখে। আমাদের উন্নতি দেখি সব দিকেই।


তবে ডিভিডি কিনে গিয়ে একটা অসাধারন ডকু দেখা হল কাল, মাইকেল মুরের সিকো
এক কথায় অসাধারন.. । মার্কিনি লোলুপ স্বাস্থ্যব্যবস্থার চরম দুর্বলতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেন পরিচালক। সচলপাঠকের প্রতি জোর অনুরোধ পারলে একবার চেখে দেখবার, পস্তাবেন না গ্যারান্টিড..
আমাদের কেন একটা মাইকেল মুর নেই? ধ্যাৎ, বরং আনিলার কথাই ভাবি..

কালেক ঈদ, শুভেচ্ছা সবার জন্য..

"দিয়েছিলে যা.. নিতে পারো সবই..... লা লা লা.."

No comments:

Post a Comment

To comment in Bangla, please use Avro Keyboard Interface. Click here for Bangla Installation Guide.

বাংলায় লিখতে অভ্র কিবোর্ড ব্যবহার করুন. বাংলা ইন্সটলেশন গাইড পাবেন এখানে