ঢাকায় এখন ভালো মিষ্টি মানেই প্রিমিয়াম সুইটস। আলাউদ্দীন আর বনফুলকে এখন সেকেন্ড গ্রেড বলে ধরা হয়। ঈদের আগের দিন টাকা তুলতে গেছি চার নম্বরে (ধানমন্ডি)। পাশেই দেখি প্রিমিয়ামের দোকান। ভাবলাম শ্বশুরবাড়ির জন্য এক প্যাকেট নেই। একটু পরে মনে হল, স্পঞ্জ রসগোল্লা খাওয়া হয়না বহুদিন, সেটাও নিয়ে ফেলি। হঠাৎ চোখ পড়ল শোকেসে সাজিয়ে রাখা ঘি এর বয়ামগুলোর উপর। শেষে কি মনে করে, এক বয়াম ঘি-ও কিনে ফেললাম।
আমি ঢাকায় তিনবেলাই আলুভর্তা আর ভাত খাই। তো ঘি কেনার পর, এখন ধোঁয়াওঠা ভাতে এক চামচ করে ঘি ঢেলে দেই। এর কি স্বাদ, তা ব্যাখ্যার ধৃষ্টতায় গেলাম না। বাঙালীর এই অমৃতের কথা ফরাসীরা জানলে হয়তো ড্রাম ড্রাম ঘি এয়ার ফ্রান্সের খালি কার্গো বিমানে ভরে নিয়ে পালাতো (বিষ্ণুমুর্তি চুরির পর বেহুদা খালি প্লেন নিয়ে কি লাভ)। ঘি এর বয়ামের দিকে হাত বাড়ালে অবশ্য বাবা কেমন ঘোঁৎ করে আওয়াজ করেন। আমি হাসি আর সুমন চৌধুরীর সিগনেচার আউরে যাই,
"ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ (ঋণ করে হলেও ঘি খাবি, যদ্দিন বাঁচবি সুখে বাঁচবি)"
ঈদের পর দিন বোরিং গেল। হাটতে বেরুলাম। পথে প্রকৃতির ডাক পেয়ে কঠিন বিপদে পড়লাম। বাইরে এ জাতীয় সমস্যার ভালো সমাধান হল ম্যাকডোনল্ডসে ঢুকে পড়া। ঈদের ছুটিতে দোকানপাট বন্ধ। ফলে বাঁচতে হলে জীপার খুলে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে পড়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। আমার জায়গায় একটা মেয়ে হলে কি হতো কল্পনা করার চেষ্টা করি! ২৭ নম্বরে ন্যান্দোস (Nando's) খুলেছে নতুন। দাঁতে দাঁত চেপে দৌড় দেই সেদিকে।
নান্দোস আমার পছন্দের জায়গা। ঢাকায় খুলেছে শুনে ভীষন ভালো লেগেছিল। দিলাম অর্ডার করে, কোয়ার্টার চিকেন মিল! খাবার ভালো, কিন্তু দামটা আরও ভালো ৩১০টাকা! মালেশিয়াতেও ঠিক এই দাম। ঢাকার মানুষের পকেট ভারি নাহলে কি করে এমন দাম রাখতে পারে এরা? ভালো লাগলো ওয়েটারদের, সবাই ছাত্র। কেউ পার্ট টাইম, কেউ ফুল টাইম। ভালো ইংরেজী বলে সবাই। কথা হল রমেনের সাথে। জানা গেল একাজে পয়সা আসে ভালোই। তাকে চাকরী পেতে রীতিমতো কয়েকধাপ ইন্টারভিউ নাকি দিতে হয়েছে।
নান্দেসোর ঠিক উল্টো দিকেই এটসেটেরা। আর এটসেটেরার দোতলায় হল দেশের বনেদী কফি শপ, "কফি ওয়ার্ল্ড"। মাসুদ ভাই বলেছিলেন, আমাকে কফিওয়ার্ল্ড আর কজমোতে মানাবে না... কথা ভুল না। নানাবয়সি যুগলের ভীড়ে খানিকটা অস্বস্তিতেই পড়তে হল। তারউপরে বনেদী দোকান, ওয়েটাররা সহজে পাত্তাও দিতে চায় না। দুটো লা'তে খেতে আমার ২৯৯টাকা বের হয়ে গেল।
দেশ যখন এদিকে অনেক এগিয়ে যাচ্ছে তখন স্টার কাবাবে গিয়ে একটু শান্তি লাগলো। তবে পেটপুরে খেতে গিয়ে (২টা খিরি, ১টা শিক, ১টা ঝাল ফ্রাই, ১টা ব্রেন, ১টা স্প্রাইট, ১টা চা, ২টা বাটার নান) লাগলো ৪০১টাকা। কি বুঝলেন?
দেশে এসে ছবি তোলার অনেক শখ ছিল। পরশু গেলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। টিএসসিতে হালকা পাতলা কিছু স্ন্যাপ নিয়ে ঢুকলাম সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। কেমন বিরান হয়েগেছে। সেই সবুজও নেই, সেই পরিচ্ছন্নভাবটাও উধাও। ঘাসওঠা মাঠে শুয়ে আছে বাস্তুহারা মানুষেরা। একটু এগুতেই চোখে পড়ল বিশাল জলাধার, যার পিছনে এক অসমাপ্ত স্থাপনা। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে যখন পৌছালাম তখন পথ আগলে দাড়াল দুই আনসার।
- "এইটা কি ভাই? কি বানায় এইখানে"
- "এইডা স্বাধীনতা ইস্তমভো.."
- "ঢুকা যাবে না?"
- "না । কাজ শ্যাষ হলে খুলে দেওয়া হবি"
- "কবে শুরু হইছে এইটা বানানো?"
- "আট বচ্ছর, এক পাট্টি শুরু করে, আরেক পাট্টি বোন্দো করে.. এখন কাজ বোন্দো আছে.. ভাই এইডা কি ভিডো ক্যামেরা?"
আমি কথা না বলি খালি চোখে একটু দেখার চেষ্টা করি। এখানে নাকি আন্ডারগ্রাউন্ড জাদুঘর হবে। বিশাল স্তম্ভ হবে, চারপাশ ঘিরে থাকবে জলাশয়.. । টেরোকোটা সজ্জিত উচু দেওয়ালে অলসভাবে বসে আছে কয়েকটা চিল। জলায়শের পানিতে কাপর ধুতে ব্যস্ত গৃহহীণ মানুষেরা। আমাদের প্রাণের গৌরবের প্রতীক সেই স্বাধীনতা স্তম্ভকে এমন পটভূমিতে কল্পনা করা কঠিন হয়ে পড়ে। প্রবেশদ্বারের পাশেই আলু চাষ হচ্ছে। স্বাধীনতায় তো আর পেট ভরে না।
হঠাৎ দূরে দেখি এক চিলতে আগুন, শিখা চিরন্তন। ক্যামেরা নিয়ে ছুটে যাই ছবি তুলতে। পথ আটকায় জলপাই ভ্রাতারা। ঢোকা যাবে না, ছবি তোলা যাবে না। তর্কে যাই না, কি দর্কার প্রকাশ্যে চড়থাপ্পর খেয়ে। শিখা চিরন্তন এর চেয়ে আমার "সম্মান" যে এখন অনেক বেশী জরুরী। এই দেশটাকে মাঝে মাঝে ব্যাখ্যা করা বড় কঠিন হয়ে যায়..
ছবি তুলতে তুলতে একসময় হাজির হই শহীদ মিনারে। ছোটবেলায় মামার সাথে ছবি তুলতে আসতাম। দুপুর ১টার পর যখন পুলিশ পাহারা উঠে যেত, তখন দেখতাম ববর্র সব যুবক আর কিশোরেরা বেদীমূল থেকে ফুল ছিনিয়ে নিয়ে কি তান্ডবই না চালাতো। এবার গিয়ে প্রথমেই ধাক্কা খেলাম, মিনারের সমানে কিশোরেরা ব্যস্ত সাইকেল রেসিং নিয়ে। প্রচুর মানুষ বেদীমূলে বসে আড্ডারত, জুতো খুলবার বিষয়টা মাথা মনে হয় আসেই না এদের। অনেক হাটায় ক্লান্ত ছিলাম। তাই সিড়িকোনায় বসলাম। এর পরবর্তী ঘটনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। কোথা থেকে হাজির হতে শুরু করলো নানা রং এর, নানা মাপের সব ছাগল। দেশের পবিত্রতম সৌধের পাদদেশে চতুষ্পদী এই নির্বোধ প্রাণীদের কি অবাধ বিচরন! কি লজ্জা! কি লজ্জা!
মাঝে মাঝে বড় অসহায় লাগে, কি অদ্ভুত ভাবেই না আমাদের চেনা শহরটা ধীরে ধীরে অচেনা হয়ে যায়..