আর কেউ না, মুস্তাফিজ ভাই। আমি মস্করা করে ডাকি দশবাইশ ভাই বলে। দশবাইশ ভাইও শীতলমুখে মস্করা করতে পটু। তাই ঠিক বুঝতে পারলাম না সে আসলেই আসছেন কিনা। একবার প্ল্যান ক্যানসেল হয়েছে ম্যালেরিয়ার কল্যাণে। রোগ থেকে উঠেই, বৌ-বাচ্চা ফেলে সে যে সত্যিই আসবেন বিশ্বাস হচ্ছিল না।
বাঙালীর অ্যাডভেঞ্চার প্রীতি কম। এদের কাছে ভ্রমন মানে দেশের বাড়ি (তা শহর থেকে গ্রামেই হোক আর বিদেশ থেকে বাংলাদেশেই হোক) যাওয়া। এই আধাবুড়া লোকটাকে যখন বললাম চলেন স্নোরক্লিং করতে যাই, সে আমাকে ভীষন অবাক করে দিয়ে রাজী হয়ে গেল। আমি মনে মনে বললাম, "বাহ!"
১৫ তারিখে এয়ারপোর্টে গিয়ে কাউকে দেখা গেল না। আমি সবসময় দেরী করে যাই। ভাবলাম দেরী দেখে চাচামিয়া ট্যাক্সি নিয়ে কেটে পড়েছেন, কিংবা আদৌ আসেন নাই। এমন সময় পিছন থেকে এক হন্তদন্ত যাত্রী ধাক্কা দিল। ঢাকা হলে ঝাড়ি দেওয়া যেত, বিদেশে আমরা বড়জোড় অগ্নিদৃষ্টি দেই। চোখ পাকিয়ে তাকাতে গিয়ে দেখি দশবাইশ ভাই!!
হাতে সময় কম। বাসা থেকে মাশীদকে তুলে নিয়ে আমরা গেলাম টুইন টাওয়ার দেখতে। কিছু ছবি তুলে গেলাম বুকিত বিনতাং এ। ফোটোশুট আর ডিনার দুইই হবে সেথায়। মুস্তাফিজ ভাই টমইয়াম সুপ টমইয়াম সুপ করে বাই দিস টাইম কানের পোকা নাড়িয়ে দিয়েছেন। তাই টমইয়াম সুপ, ব্ল্যাকপেপার বিফ আর চিকেন ফিশ দিয়ে ভুড়িভোজের আয়োজন হল।
বাড়ি ফিরে হালকা গোছগাছ করে আমরা ভোর তিনটায় রওনা দিলাম মার্সিং জেটির দিকে। জায়গাটা একদম দক্ষিনে সিংগাপুরের কাছে, যেতে হয় জোহর বারু রাজ্যের উপর দিয়ে। প্রথম আড়াইশো কিলো চালানোর পর আমার চোখ ঢুলুঢুলু। এদিকে দশবাইশ দাদারও গাড়ি চালানোর একটা চাপা খায়েশ ছিল। "চালাবেন নাকি?" জানতে চাওয়ায় চাচা রাজি হয়ে গেলেন। আমি নাক ডাকতে লাগলাম আর তিনি মনে আনন্দে আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে গাড়ি চালিয়ে সকাল আটটার দিকে মার্সিং হাজির হলেন। ভাবছেন রাস্তা চিনলো সে কেমন করে? এ আর কি কঠিন কাজ যদি GPS থাকে!
মার্সিং থেকে ফেরি নিয়ে যেতে হয় তিওমান দ্বীপে। তিওমান দ্বীপের অনেক সৈকত। আমরা গেলাম একদম মাথায়, সালাং সৈকতে। জেটিতে নেমেই মনটা ভালো হয়ে যায়। নীল পানি, সোনা সোনা বালি..
আমি বিড়বিড় করে আমীর খসরু আউরে যাই, "আগার ফিরদৌস বারুহে জমিনাস্ত, হামিনাস্তো হামিনাস্তো হামিনাস্ত.." (স্বর্গ যদি থাকে, তাহলে সে এখানেই.. এখানেই.. এখানেই..)
কিন্তু স্বর্গে নেমে দশবাইশ ভাই বিপদে পড়ে গেলেন। রোগে ভুগে প্যান্ট ঢিলা হয়ে গেছে, একটু পরপর ফট করে নেমে যায়। যাইহোক, টেনেটুনে কোনমতে ইজ্জত রক্ষা করে শ্যালেতে পৌছালাম আমরা। এরপর কি হল সেই গল্প মুস্তাফিজ ভাই বলবেন, কারন আমার গল্প ওনাকে নিয়ে, তিওমানভ্রমন এখানে ঠিক মুখ্য নয়।
প্যান্ট কেন ঢিলা?
স্কুবা ডাইভিং যখন করতেই হবে..
এই ছেলে এতো ছবি তুলে কিসের ধান্দায়?
যীশু যীশু ভাব, নবুওতের অভাব..
এখনও তোলা শেষ হয় নাই?
দশ-বাইশে মৎস্য শিকার
সৈকতে কি খোঁজে সে?
ভাগ্যিস G9টা সাথে ছিল
বেশী টমইয়াম সুপ খেলে এই হয়
ওই চিংকু, ফটু তোলা জানোস?
তিওমানে দু'রাত থেকে আমরা বহু যন্ত্রনা করে কেএল ফিরে গেলাম। পথে ফ্ল্যাট-টায়ার হয়েছিল। চাচামিয়া বহু ঘাম ঝড়িয়ে চাক্কা পাল্টানোর কাজও করলেন। কি লজ্জার কথা! বেচারা অতিথি, তাকে এই কষ্ট না দিলেও হতো।
পরদিন দুপুরে মুস্তাফিজ ভাইকে নিয়ে আবার যাওয়া হল বুকিত বিনতাং এ, শপিং এর ধান্দায়। ভদ্রলোক লাওইয়াত প্লাজা থেকে দুম করে ছশো রিংগিত দিয়ে লোপ্রো ৪০০ অলওয়েদার কিনে ফেললেন। গর্বিত ব্যাগমালিক হয়ে দশবাইশ ভাই এর মুখ চকচক করতে থাকে। এমন সময় মাশীদ বললো সুংগাই ওয়াং প্লাজায় ফ্যাশন শো হচ্ছে। আমি আর মুস্তাফিজ ভাই দিলাম ছুট। মাথায় বাবরি, হাতে সাদালেন্স, পিঠে মোটকা ব্যাগ দেখে লোকজন যায়গা ছেড়ে দিল। দশবাইশ ভাই ফোটু খিঁচতে লাগলেন মনের সুখে।
শপিংমলেও রক্ষা নাই
শিকারী ও শিকার
গর্বিত ব্যাগমালিক
দুপুরে খাওয়া হল ব্যাংকক জ্যাম নামের রেস্তোরায়, কারন সেই একটাই, ভালো টমইয়াম সুপ খাওয়ানো। ইতোমধ্য আমার ছবি তোলায় চাচা প্রায় অস্থির হয়ে গেছেন, একবার তো মনে হল, আরেকবার শাটার টিপলেই থাবড়া দিবেন!
মেনুতে টমইয়াম সুপ দেখি না কেন?
থামলে ভালো লাগে..
আরেকবার শাটার টিপ দিলে কিন্তু মাইর খাবেন!
সন্ধ্যায় পুত্রাজায়ায় গেলাম। পুত্রাজায়ার স্থাপত্য চমৎকার। মাগরিবের সময় আকাশ ফেটে রং ঝরে। দশবাইশ ব্যবহারের উত্তম জায়গা এটা। মুস্তাফিজ ভাই এর হাটা বদলে গেছে ব্যাগের কারনে, লোপ্রোর ব্যাগ কাঁধে থাকলে সবাই কেমন নিজেকে বীরপুরুষ ভাবা শুরু করে। বুঝলাম আমারও একটা কেনার সময় হয়ে গেছে!
পুত্রাজায়ায় মুস্তাফিজ ভাই বেশী সুবিধা করতে পারলেন না। তার একটা বড় কারন ট্রাইপড। লোকে কেন পনেরবিশ হাজার টাকা দিয়ে ট্রাইপড কেনে সেইটা আমাদের দশবাইশ দাদা হাড়ে হাড়ে টের পেলেন! যারা ট্রাইপড কিনবেন, তারা অবশ্যই একটু খরচ করে হাতে ব্যবহার করে ভালো জিনিসটা কিনবেন। না হলে কঠিন পস্তাতে হবে।
পুত্রাজায়া অভিযান
ট্রাইপড ভ্যাজাল করলে চাচ্চুদেরও রাগ হয়
আর তুলুম না, হালার ট্রাইপড!!
নটার দিকে শুটিং শেষ করে আমরা আবার গেলাম লাওইয়াতে, মাতিসের জন্য Wii কিনতে। ক্লান্তির কারনে ছবি তোলা থেমে গেছে অনেক আগেই। দোকান থেকে খাবার কিনে আমরা বাড়ি গিয়ে গল্প করতে করতে ডিনার সারলাম। ভদ্রলোক চলে যাবেন ভোর ছটার ফ্লাইটে। ক'টা দিন ভালোই কাটলো। খানিকটা বিষন্ন হয়েই চিন্তা করতে থাকি, এই মাঝবয়েসী তরুনের সাথে আবার কবে বেড়ানো যাবে?
থ্যাংক ইউ মুস্তাফিজ ভাই... আস্তা লাভিস্তা!!
ট্রাইপডের পিছনে চাচ্চুর ছবিটা জোস আসছে !
ReplyDelete