গত ৭ই জানুয়ারী ম্যাক্কারী কুয়ালা লুমপুর এর ইসলামিক আর্টস মিউজিয়ামে তার "A Common Faith" শিরোনামে তার ছবির প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন। সেখানে ম্যাক্কারীর আলোচনা শোনবার ও প্রশ্ন করবার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। পরদিন তার পরিচালিত মাস্টারক্লাসে আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে আলোচনার সুযোগ ঘটে। এই লেখায় সেই আলাপচারিতাই খানিকটা সাক্ষাৎকারের ভঙ্গিতে সংকলিত করা হল। বলে রাখা ভালো, ম্যাক্কারী ভীষণ রসিক, আলাপের নানা পর্যায়ে তার তামাশার নমুনা পাওয়া যাবে।
* * * * * * * * * * * * *
ইসলামিক আর্টস মিউজিয়ামে ম্যাক্কারী, আলোকচিত্র:লেখক
ছবি তুলতে হলে কোন বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে বলে মনে করেন?
ওয়েল, আমি মনে করি ফোটোগ্রাফিতে কিছু জরুরী বিষয় আছে। তার মধ্যে একটি হল অপেক্ষা করা, কখনও তোমাকে সঠিক আলোর জন্য অপেক্ষা করতে হবে, কখনও তোমাকে সঠিক অভিব্যক্তির জন্য অপেক্ষা করতে হবে। ধরো, কারো সাথে দেখা হল, তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে, যতোক্ষন না সে ক্যামেরার সামনে স্বস্তিবোধ করে। আমার তো মনে হয় ছবি তুলতে গিয়ে আমি মূলত অপেক্ষাই করি বেশী। আমি বড্ড অধৈর্য্য মানুষ, তাই অপেক্ষা করা আমার জন্য কষ্টকর কাজ (হাসি)..
ফোটোগ্রাফি আসলে শিকার করার মতো। তুমি খুব ধীরে, কায়দাকরে এগুতে থাক, তারপর শিকারের উপরে ঝাঁপ দেওয়ার ঠিক মুহুর্তটার জন্য অপেক্ষা কর। অনেক নজরদারি প্রয়োজন। অপেক্ষা করা হল পুরো প্রক্রিয়ার একটা গুরুত্বপূর্ন অংশ। কোথাও গিয়েই ছবি তুলতে নেমে পড়াটা ঠিক না। বরং চারদিক খেয়াল করতে করতে ধীরেসুস্থে এগুতে থাক।
আপনি কি ফিল্ম ব্যবহার করেন না ডিজিটাল?
আমি এখন পুরোদস্তুর ডিজিটাল। কোডাক আমাকে কোডাক্রোমের শেষ রোলটা উপহার দিয়েছে।। তারা এর উৎপাদন চরদিনের জন্য বন্ধ করে দিয়েছে। আর শেষরোলটা দিয়েছে আমাকে (হাসি)
লেখকের মন্তব্যঃ
১. ম্যাক্কারী কোডাক্রোম সিক্সিটিফোর ফিল্মেই সবচে' বেশী কাজ করেছেন। এই ফিল্মের স্যাচুরেশন ছিল অতুলনীয়। ২০০৯ সালে কোডাক এর উৎপাদন সম্পূর্ন থামিয়ে দেয়।
২. ম্যাক্কারী Nikon D3S ও Hasselblad H3DII-39 ক্যামেরা ব্যবহার করেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি Nikon এর ভক্ত
তো সেই শেষ ফিল্মটা দিয়ে কিসের ছবি তুলবেন?
মালেইশিয়া ফিরে এসে একটা স্টোরি করবো(হাসি, তামাশা ছিল)
সিরিয়াসলি, নিউইয়র্কের কিছু ছবি তুলবো। আর ছবি তুলবো পল সাইমনের (গায়ক) । পলের একটা গান ছিল নাম "কোডাক্রোম"। এই বিখ্যাত গানটার জন্য আমি ওর কিছু ছবি তুলব। এছাড়া আরও দু'একটা বিষয় নিয়ে হয়তো ছবি তুলবো ওই ফিল্মে।
ফিল্ম থেকে ডিজিটালে যেতে সমস্যা হয়নি?
বছর চারেক আগে আমি সম্পূর্ন ডিজিটালে চলে যাই। প্রথম দিকে সমস্যা হলেও এখন বরং ভালোই লাগে। লো লাইটে অ্যাকশন ফ্রিজ করার এমন সুযোগ ফিল্মে ছিল না।
পোস্ট প্রসেসিং এ কী সফটওয়্যার ব্যবহার করেন?
আমরা লাইটরুম নামে একটা টুল ব্যবহার করি
"আমরা "বললেন কেন? কেন "আমি" না?
আসলে আমি তো পোস্টপ্রসেসিং করিনা। এসবের জন্য লোক আছে। আমি বলে দেই, ওরা সেই মতো করে।
From অরূপকথা |
অং সান সু কি-র ছবিটায় কি রিফ্লেকটর ব্যবহার করেছিলেন? কিংবা ফিল ফ্ল্যাশ?
আমি ফরমায়েশী কাজ ছাড়া আর্টিফিশিয়াল লাইটিং ব্যবহার করি না বললেই চলে। সু কি-র ছবিটা ন্যাচরাল লাইটে তোলা। আমার অধিকাংশ ছবিই ফ্ল্যাশ, রিফ্লেক্টর ছাড়াই তোলা।
ছবি তুলবার সময় কি খেয়াল করেন?
চারপাশে কি ঘটছে সেসব খেয়াল করতে হয়, অ্যাপ্রিশিয়েট করতে হয়। তোমাকে অনেক সংবেদনশীল হতে হবে। হতে পারে সাইডওয়াকে একটা ফাটল, হতে পারে একদল শিশু খেলছে সেখানে। কিংবা একটা কুকুর। বিষয়টাকে যে খুব সুন্দর হতে হবে তা না, একটা ইন্টারেস্টিং কিছু থাকতে হবে, যা তোমাকে নাড়া দেয়, তা যাই হোক। এই ধর রাস্তায় কেউ শুয়ে আছে দলা পাকিয়ে। সেটা আগ্রহব্যঞ্জক হতে পারে, তাই না? এইসব ছোট ছোট বিষয় আর কি..
আপনি কি ছবি তোলার সময় মডেল রিলিজ নেন?
নাহ, কখনওই না। চিন্তা করো, ছবি তোলার আগে তুমি কাগজ নিয়ে দৌড়াচ্ছ মডেল রিলিজ নিতে। আমি ছবি তোলা বাদ দিয়ে ওসব নিয়ে দৌড়াতে পারবো না।
সমস্যা হয়নি এ নিয়ে?
হয়, তবে খুব বেশী না। আর হলেও মডেল রিলিজ না নিয়ে আমি জরিমানা দিতে রাজী আছি। প্যারিসে একবার কেস করেছিল। দশহাজার ডলার ফাইন করেছিল। নো বিগ ডিল আমার কাজের তুলনায়।
উন্নতদেশে ছবি তোলা আর উন্নয়নশীল দেশে মানুষের ছবি তোলার মাঝে পার্থক্য আছে কি কোন?
আমার মনে হয় উন্নতদেশে লোকজন খানিকটা প্যারানয়েড, খানিকটা নিউরটিক। এই ধর তুমি কারো বাচ্চার ছবি তুললে, সে তোমাকে পেডোফাইল ভেবে বসবে। আবার বাংলাদেশের কোন শিশুর ছবি তোল, তারা বাবামা হয়তো ভীষণ খুশিই হবে। উন্নয়নশীল দেশে ছবি তোলা তাই খানিকটা সহজই বলা যায়।
ফোটোগ্রাফারদের কি তাদের ছবি নিয়ে লেখা উচিত?
ফোটোগ্রাফাররা যদি তাদের ছবি নিয়ে লিখতে আগ্রহী হন সেটা দারুন হয়। অঁরি কার্তিয়ে ব্রেঁসো, এডওয়ার্ড ওয়েস্টন, এরা খুব ভালো গুণী লেখক ছিলেন। আবার আরেকদল ফোটোগ্রাফার আছেন যারা, আমি মনে করি, ক্যামেরার মাধ্যমেই সবচে' ভালো বলতে পারেন। দুর্ভাগ্যবশতঃ আমি মনে হয় সেই দলেই পড়ি। তবে আমি মনে করি এসব নিয়ে কোন নিয়মকানুন থাকা উচিত না। আমি প্রচুর ওয়ার্কশপ করি, তাতে আমি তাদের সাথেই কাজ করতে ভালোবাসি, যারা ভালো ছবি তোলা নিয়ে পাগল থাকেন। আমি যদিও লিখি কিন্তু সেটা এডওয়ার্ড ওয়েস্টনের মতো ডায়েরী লেখা জাতীয় কিছু না। আমার দু'কানের মাঝে এসবের জন্য প্রয়োজনীয় ঘিলুটাই নেই (হাসি)।
আপনি তো অনেকদেশেই ছবি তোলেন। অনেকে ছবি তার ছবি তোলা হোক, বিষয়টা পছন্দ করেন না। এক্ষেত্রে আপনি কি করেন? আরেকটা প্রশ্ন, যতোছবি তোলেন তার কতোগুলো মাস্টারপিস হয়ে বের হয় শেষমেষ?
যতোই বোঝাও কিছুলোককে কোনভাবেই ছবি তুলবার জন্য রাজী করানো যায় না। সে যতোই ছবি তুলবার মতো সাবজেক্ট হোক, তোমাকে ওই ছবিটা হাতছাড়া করতেই হবে। এটা হবেই আর তোমাকে তা মানতে হবে। যতোই বুঝাও, যতোই আদর করো, যতোই তাকে ... (এই পর্যায়ে ম্যাক্কারী হাত দিয়ে কারো মাথায় চাটি মারার ভঙ্গি করে হাসতে থাকলেন) তোমার হাল ছাড়তেই হবে..
দশজনে ন'জন ছবি তোলা নিয়ে আপত্তি করবেন না কিন্তু একজন বাগড়া দেবেই। তোমাকে সেটা সম্মান করতে হবে। হয়তো তার পরিবারে কেউ মারা গেছে, কিন্তু সে চাকরী হারিয়েছে, তুমি জানো না কি চলছে তার মনের মধ্যে। ছেড়ে দাও তাকে, এটা নিয়ে আর গুঁতোগুতি করো না। হাল ছেড়ে দাও, সামনে আগাও। এটা হবেই, আর তোমাকে সেটা মেনে নিতে হবে..
সংখ্যানুপাতে মাস্টারপিস আসলে খুব কম। ব্রেঁসো তো বলেছেন, তোমার সারা ক্যারিয়ারে হয়তো ভালো ছবি থাকবে বড়জোড় একশ/দুশ। আমি তো মনে করি খুব কম ছবি শেষ পর্যন্ত মনে রাখার মতো হয়।
আপনি তো বহুদেশে ঘুরেছেন। আপনার ছবি তোলা আপনাকে কিভাবে বদলে দিয়েছে?
মনে হয় আমি খানিকটা পাগলা হয়ে গেছি (হাসি), তামাশা করলাম
আসলে আমি দুনিয়াকে খুব ভালো করে দেখার সুযোগ পেয়েছি। কতো ধর্ম আছে! কতো কৃষ্টি আছে!! কিন্তু সারা দুনিয়া ঘুরে ঘুরে আমি তাদের মিলগুলো দেখেছি। দেখেছি আমরা কতোটা একই রকম। আসলে একটা পাতলা আবরনের নীচে আমরা সবাই একই রকম, আমরা সবাই ভালোবাসা চাই, শ্রদ্ধা চাই, একই ভাবে স্বপ্ন দেখি..
আমার বদলানোর কথা প্রসঙ্গে বলতে হবে, আমি অনেক সহনশীল হয়েছি, আর শিখেছি প্রকৃতিকে ভালোবাসতে।
আপনি বিভিন্ন মানবিক পরস্থিতিতে ছবি তুলেছেন। ছবি তুলবার সময় কি আবেগকে দূরে রাখেন?
আমার মনে হয়, তুমি যখন আবেগময় পরিস্থিততে ছবি তুলতে যাও, তখন তোমার আবেগের কারনে প্যারালাইজড হয়ে যাওয়া উচিত না। তোমার আবেগ থেকে তোমার সেরকম মানসিক দূরত্ব রাখতে হবে যতোটা রাখেন একজন ডাক্তার। তার অপারেশন টেবিলে প্রতিদিনই কেউ হয়তো মারা যায়, কতো দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। কিন্তু তাকে তো ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। তাকে এমন মানসিক অবস্থায় থাকতে হবে যেন সে তার কাজ করে যেতে পারে, যে কাজে সে ঢুকেছে হয়তো মানুষের মঙ্গলের জন্যই।
আমরা যারা ছবি তুলি বিভিন্ন জটিল পরিস্থিত পরিবেশে, যারা জীবনকে উৎসর্গ করেছি এই কাজে যেন দুনিয়া আরো জানতে পারে, বুঝতে পারে, সেখানে আমি নিজেকে সেই সার্জনের জায়গায় দেখি, মৃত্যূ ও ট্র্যাজেডীর সাথে যাদের প্রতিদিন দেখা হয়..
এই লেখাটা তৈরি করা হয়েছিল একটা পত্রিকার জন্য, সেই পত্রিকা মনে হয় না খুব তাড়াতাড়ি বের হবে, তাই ব্লগেই ছেড়ে দিলাম..
চমৎকার লেগেছে অরূপ!
ReplyDeleteধন্যবাদ অরূপ ভাই...চমৎকার লাগলো !!
ReplyDeleteপ্রিয় অরূপ
ReplyDeleteজন্মদিনে অনেক অনেক অনেক শুভেচ্ছা।
ভালো থাকুন সবসময় ভাই।
তানিয়া