ফ্লিকারে বেশ কটা বাংলাদেশী গ্রুপ আছে। মুস্তাফিজ ভাই এর সূত্রে বিপি-র (বাংলাদেশী ফোটোগ্রাফার্স) সাথে চিন-পরিচয় হয়েছে। মুস্তাফিজ ভাই এর বাড়িতে ডিনারের দিন কর্তাদের সাথে হালকা গফসপ হল, ছবির হাটের মিটিং এ বাকিদের সাথেও আলাপ করার একটা মওকা মিলল। গিয়ে দেখি সব বাচ্চাছেলে (ইয়ে মানে.. আমার চেয়ে বুড়া মানুষ বেশী নাই )। তো এই বাচ্চাছেলেগুলো আবার ছবি তোলে অসাধারন, একেকটার ছবি দেখলে মনে হয় ক্যামেরা বেচে দিয়ে নেঙটি পড়ে ভিক্ষা করি। এরা ছবি তুলতে প্রায়ই দল বেঁধে ফোটোওয়াকে বের হয়। ফোটোওয়াকের গল্প শুনতে শুনতে আমারও লোভ হচ্ছিল বের হতে। আমার কপাল সেদিন ভালো ছিল, মনির (Flickr ID: Catch the Dream) ঘোষনা দিল নতুন বছরের দ্বিতীয় দিনে তারা যাবে মানিকগঞ্জে, ফোটোওয়াকে। আমাকে আর পায় কে! ফ্লিকারে যখন ঘোষনা এল তখন আমি কিঞ্চিৎ চিন্তিত, সকাল আটটায় যেতে হবে ফুলবাড়িয়া BRTC বাস স্ট্যান্ডে। ঢাকায় আমি ঘুম থেকে উঠি বিকার ৪টায়, তার উপরে ফুলবাড়িয়া বাস স্ট্যান্ডে জিন্দেগীতে যাইনি। কি যন্ত্রনা!
দুই তারিখ ঘুম ভাঙলো ঠিক সময়ে, কিন্তু জায়গামতো হাজির হতে হতে সাড়ে আটটা বেজে গেল। মুখচেনা সব গুণধরেরা হাজির। জনপ্রতি চান্দা দুশ টাকা, সেই টাকায় খানাদানা আউর যানাবাহানা। নাস্তা অনেকেই করেনি, তাই মামুর দোকানে সবাই বসে গেল ভাজি পরোটা খেতে। শীতের সকালে ভাজি-পরোটা আর চা! আহা!!..
আমি জানতাম জনগন সিংগাইর যাবে, বাড়িতে সেইরকমই বলা। তিন ঘন্টা বাসযাত্রার পর জানা গেল আমরা যেখানে হাজির সে জায়গার নাম পাটুরিয়া। পাটুরিয়ার নাম এই জীবনে শুনিনি, ছবি তোলা গেলেই হয়।
যাইহোক, ফোটোওয়াকের মধ্যে কেমন একটা পিকনিক পিকনিক ভাব আছে। সবাই যন্ত্রপাতি বের করে শিশুর মতো উদ্দীপনা নিয়ে ছুটতে লাগলো বালুচরে। শরীফ ভাই কাজ করেন নিয়েলসন কাম্পানীতে, শখে ছবি তোলেন। দলে তিনিই সবচে' বড় (ভদ্রলোক কেমন ছবি তোলেন সেটা জানতে চাইলে ফ্লিকারে Ideas are Bulletproof নামের লোকটিকে খুঁজে বের করুন) । অনেকক্ষন ধরে খেয়াল করছিলাম ভদ্রলোক টিফিনব্যাগ নিয়ে ঘুরছেন। চরে নেমে তিনি সেই ব্যাগ থেকে বের করলেন সিগমা-র ৫০০মিলিমিটার টেলিফোটো লেন্স। আমি মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। টেলিফোটোর দাম দেখে আমি ওই রাস্তা ছেড়ে দিয়েছি। অগ্রজকে "ছিল" দিয়ে একটা ক্যাননের 35mm f/1.4 L লেন্স বাগিয়ে ফেলেছি। সেটা হাতে পেয়েছি কদিন হল। আজকে আমার হাতিয়ার হবে এই বস্তু।
চরে গিয়েই মনে হল জানা দরকার নদীটার নাম কি। ছড়াকার টিপু কিবরিয়া গম্ভীর মুখে বললেন পদ্মা। আমার সাথে এই লোকের তামাশা করার কথা না। তারপরও কথা মানতে পারলাম না। আসতে যে তিন ঘন্টা লেগেছে সেইটা মাথায় রাখলে হয়তো বিব্রত হতে হতো না।
চরে ছবি জমলো না। সর্ষে ফুল সামান্য, পাখিও নেই তেমন (শরীফ ভাই এর অবশ্য দাবী তিনি হুপো দেখেছেন) । লোকজন কিছক্ষন এটা সেটা তুলে ঘাটের দিকে রওনা হল। হেতু মধ্যাহ্নভোজন।
ঘাটের ইলিশ মাছের বহু গল্প শুনেছি। খাবার সুযোগ ছাড়ি কিভাবে? কিন্তু ইলিশ মাছের তরকারী বলে যা দেওয়া হল তাকে কেবলই তৃতীয় বিভাগে পাশ মার্ক দেওয়া যায়, একে নিয়ে "স্টারপেয়েছি" টাইপ খাজুরে আলাপ জুড়ে দেওয়া না।
ঘাটে ভালোই ভিড় ছিল। অনেক আগে আরিচা আর নগরবাড়ী ঘাট হয়ে পাবনা যাওয়া হতো। তারপর অনেক দিন হল ঘাট মাড়ানো হয়নি। এবার এসে মজাই লাগলো।
খাওয়া দাওয়া শেষ হতেই পুরো দলটা রিক্সা নিয়ে ছুট দিলো গ্রামের দিকে। আমরা হাজির হলাম যে গ্রামটায় তার নাম "নালী"। "নালী" টিপিক্যাল বাংলাদেশী গ্রাম। সর্ষে ফুলে হলুদ হয়ে আছে, লাউয়ের মাঁচায় লেজ ঝুলিয়ে বসে আছে ফিঙেপাখি। এমন দৃশ্য দেখে সবাই খানিকটা মাতাল হয়ে ওঠে। ১৫টা ছেলেবুড়ো ধাপধাপ নেমে যায় সর্ষে ক্ষেতে। এমন সময় কে যেন হাঁক দিল, "বাচ্চা দরকার, বাচ্চা"
মানে কি?
মানে পরিস্কার হতে দেরী হল না। গ্রামের বাচ্চাদের দিয়ে মডেলিং করানো হবে, তাই বাচ্চার খোঁজ। বাচ্চা পেতে বেশী দেরী হল না, জনা পাঁচেক হাজির হয়ে গেলেন নিমেষেই। বাচ্চাকাচ্চাদের পেয়ে সবাই নানা কসরতে নানা অ্যাঙ্গেলে ছবি তুলতে শুরু করলেন, আমিও বাদ থাকলাম না।
পনের জনের ষোলটা ক্যামেরা পারলে পুরো গ্রামটা চেয়েপুটে খেয়ে ফেলে। পুলাপাইন চান্সে পেয়ে মাঝে খেজুরের বাসি রসও খানিকটা খেয়ে নিল। একজন ঝাড়ি খেল পুকুরঘাটে স্নানরতার ফোটো খিঁচতে গিয়ে।
লোকে যে বলে বাংলাদেশের মানুষ খুব হসপিটেবল, সেটা খুব ভুল না। অচেনাঅজানা একদল লোক বিনানুমতিতে বাড়ির চৌহদ্দিতে ঢুকে ফোটো তোলায় কারো আপত্তি দেখা গেল না, বরং চেয়ার এনে বসার সুব্যবস্থা করতে ব্যস্ত হলেন গৃহকর্তা।
"নালী" গ্রামে ছবি তোলার অনেক বিষয় ছিল, কিন্তু সূর্য হেলে পড়ল পশ্চিমে। লোকজন খানিকটা বাধ্য হয়েই, ফিরতি পথে রওনা দিল।
ঢাকায় আসবার আগে বারবার মনকে বলেছি, "ঢাকা খারাপ, ঢাকা নোংরা, ঢাকায় জ্যাম, ঢাকায় নেট স্লো"। ফোটোওয়াকে গিয়ে মনটাই খারাপ হয়ে গেল। এই বাউন্ডুলেগুলো মনে করিয়ে দিল, এই শহরটাকে এখন জড়িয়ে ধরে থাকার মতো কিছু বিষয় আছে। মুস্কিল হল, আর দুটো দিন পড়েই হাত নেড়ে চলে যেতে হবে।
আমার একদম ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না... একদম না...





















No comments:
Post a Comment
To comment in Bangla, please use Avro Keyboard Interface. Click here for Bangla Installation Guide.
বাংলায় লিখতে অভ্র কিবোর্ড ব্যবহার করুন. বাংলা ইন্সটলেশন গাইড পাবেন এখানে।