উইকএন্ডটার জন্য আমরা দু'জনাই অনেক আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম।
"ফ্রেজার হিলে যাই চলো শনিবার, দিনে গিয়ে দিনেই ফেরা যাবে", মাশীদকে বলি। কি ভেবে সেও রাজী হয়ে যায়।
ফ্রেজার হিলে আগে গিয়েছিলাম একবার, পাখি দেখতে। রাস্তা দুর্গম আর বিনোদনের অভাব বলে সহজে ওদিকে কেউ যায় না। আগেরবার যেখানে ছিলাম সে হোটেলের ভাড়াও কম। তাই চট করে ঘুরে আসার জন্য জায়গাটা মন্দ না যদি পাখপাখালি আর পাহাড় নিয়ে আপনার আগ্রহ থাকে।
শখ ছিল ছবি তুলব, পাখির ছবি তুলতে হলে আবার শুরু করতে হয় আলো ফোটার আগেই। সে হিসাবে ভোর পাঁচটায় রওনা দেবার কথা ছিল। শেষ পর্যন্ত রওনা দিলাম সাড়ে আটটায়, আর পাহাড়ের মাথায় পৌছাতে পৌছাতে সাড়ে বারোটা।
সাড়ে বারোটায় পাখির দেখা পাওয়াটা খানিকটা র্যান্ডম ঘটনা হয়ে পড়ে। তাই এ পাহাড়ের মাথা-সেমাথা ঘুরে ঘুরে সময় কাটলো।
গতবার ছিলাম জেলাই হাইল্যান্ড রিজর্টে। বিশাল হোটেল, অবস্থা করুন। গেস্ট বলতে আমরাই। মাশীদের আব্দার স্মোক হাউজে থাকবে। আমি মানতে নারাজ, গেলবার হোটেলের বারান্দায় অনেকরকম পাখি ছিল, সেই সুযোগ ছাড়তে আমি রাজী নই।
ফ্রেজার হিলে ওঠার জন্য শেষ সাত কিলোমিটারকে বলে দ্য গ্যাপ। লাটসাহেবেরা এই রাস্তা তৈরি করে দিয়েছিলেন, তারপর আর কোন বদল নেই। গ্যাপ হল এক লেনের রাস্তা। বিজোড় ঘন্টায় গাড়ি উপরে ওঠে আর জোড় ঘন্টায় নীচে নামে। গ্যাপ এতোটাই বাঁকাচোরা যে স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে হাত ব্যথা হয়ে যায়। রাস্তা কতো বাঁকা সেটা জিপিএস-এর ম্যাপে দেখলে বোঝা যেতে পারে।
ফ্রেজার হিলে গল্ফ ক্লাব আছে, বাংলো আছে। কিন্তু বার কিংবা রেস্তোরা নেই। নেই দোকানপাট কিংবা নাইটক্লাব। থাকার মধ্যে আছে একটা ফুডকোর্ট, রাতে খেতে গেলাম সেখানেই। এখানে খাবার বেশ সস্তা। গরম ভাতের সাথে ঝাল-মিষ্টি গোশ আর কফি - এই খেতে দুজনের পড়ল ষোল রিঙ্গিত। বাইরে ভালোই লাগছিল ঠান্ডার মধ্যে। কিন্তু শীতের কাপড় আনতে ভুলে যাবার জন্য বেশীক্ষন থাকাটা বিপজ্জনক হয়ে গেল, বাধ্য হয়েই রুমে ফিরতে হল। এবার পরিকল্পনা ভোর ছটায় উঠবার। ছটায় উঠলাম ঠিকই, কিন্তু মাশীদের শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না বলে, ভাবলাম আরেকটু থাকি। দেখি সেই আমাকে বলে "ছবি তুলবে না?"
জ্যাকেটটা গায়ে চাপিয়ে লাগোয়া বারান্দায় একটা উকি মারতে গেলাম বিশাল হাই তুলে। গিয়ে আমি হতবাক! নীচে চারপাঁচটা মিলিটারীর লোক দাড়িয়ে! এতো মহাযন্ত্রনা!
চোখ কচলে আবার দেখি! বন্দুক তো দেখা গেলনা... বেশী দেরী হল না বুঝতে, এরাও এসেছে পাখির ছবি তুলতে, পাখি যেন ভয় না পায় তাই মিলিটারী ক্যামোফ্লাজ ড্রেসে সেজেছেন তারা। প্রত্যেকেরই ৬০০ মিলিমিটারের লেন্স (দাম বাংলা টাকায় আড়াই/তিন লাখের মতো হবার কথা)। বোঝাই যাচ্ছে এনারা প্রোফেশনাল, দামী ক্যামেরার সাথে দামী ফোর হুইলারও আছে। মাশীদকে ডেকে দেখাই।
ভদ্রলোকদের দেখে আমাদের উৎসাহে ঘি পড়ল। মুশকিল হল মেঘ। ঘন মেঘে পাহাড় ঢাকা, এতে ছবি তোলা কঠিন, তা দুনিয়ার সেরা ক্যামেরা থাকুক আর না থাকুক।
গেলবার লাফিং থ্রাশের ছবি ভালো তুলতে পারিনি, এইবার এক্কেবারে সমানে বসে তারা ডাকাডাকি করেছেন। গানের গলাও ভালো। আগের ক্যামেরাটা থাকলে ভিডিও করে রাখা যেত।
আমাদের কপাল ভালো। পাখির দল জংলী ভাইজানদের বাদ দিয়ে আমাদের দিকে জটলা শুরু করলো। মেশিনগানের মতো ফোর্টিডি চালিয়ে আমরা দৌড় দিলাম হোটেলের দোতলায়। সেখানকার ফুল গাছে স্পাইডারহান্টার ঘুরে বেড়ায়। অনেক কায়দা করে তাকেও ধরা গেল
দশটার দিকে মনে হলে নাস্তা করাটা জরুরী। নীচে নেমে দেখি জংলীগ্রুপ গায়েব। তাদের ছিটানো রুটির টুকরো খেতে নেমেছে একদল লম্বাল্যাজা সিবিয়া। সিবিয়া দেখতে সুশ্রী নয়, কিন্তু তা গানের গলায় পুষিয়ে নিয়েছে ভালোই
সেই আগের জায়গায় গেলাম নাস্তা করতে। বিফ রেন্দাঙ দিয়ে নাসি লেমাক। তারপর একমগ গরম তে-তারিক! ইতোমধ্যে আমরা খেয়াল করলাম জংলী গ্রুপও একই জায়গায় খেতে এসেছে। বেচারাদের কপাল ভালো না। এতো লটবহর এনেও সুবিধা করতে পারলো না।
নাস্তা শেষে আবার হোটেলে পাখি শিকার শুরু হল। আমার চেয়ে মাশীদের আগ্রহ অনেক বেশী। তাকে টেনে সরানো যায় না। বুকে ১০x জুম ওয়ালা ক্যামেরা কিনে দেবার এই বিপদ!
বারোটায় চেক আউট করে গাড়ি নিয়ে রওনা দিলাম টেলিকম লুপে। গেলবার হেঁটে হেঁটে পুরোটা ঘুরেছি, এইবার চালাকি করে গাড়ি এনেছি। টেলিকম লুপ হল জংলা জায়গা, তাই পাখি দেখা যাবার কথা বেশী। তবে ছবি তোলবার জন্য যে ভালো না সেটা বুঝতে আমাদের বেশী দেরী হল। টেলিকম লুপে ঘুরতে গিয়েই দেখা পেলাম রূপালী কানের মেসিয়ার। এই মেসিয়া পাখি নাকি ফ্রেজার হিলের আনঅফিসিয়াল মাস্কট।
ফেরার পথে গলফ গ্রীনের কাছে গাড়ি থামলো। এই খানটায় প্রচুর সোয়ালো পাখি ওড়ে। প্র্যাকটিক্যাল ফোটোগ্রাফি ম্যাগাজিন মতে পাখির ছবি তোলার ডিফিকাল্টি লেভেল আছে ১৪টা। বালিহাঁসের ছবি পড়ে ১০এ, আর সোয়ালো একদম ১৪তে। কঠিনরকম দক্ষতা না থাকলে এ পাখির ছবি তোলার চেষ্টা না করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
আমি যখন হাঁপিয়ে উঠলাম তখনও দেখি আমার ভদ্রমহিলা ছুটে বেড়াচ্ছেন। এক পর্যায়ে ফোন! তার ব্যাটারী খতম। অগত্যা ফ্ল্যাশ থেকে দুটো খুলে দিলাম। বুদ্ধিমানেরা সাথে এক্সট্রা ব্যাটারী, এক্সট্রা মেমোরী কার্ড, চার্জার রেখে দেয়। আমরা সাফল্যের সাথে নিজেদের বোকা প্রমাণ করেছি। বেশী বুদ্ধিমান হবার সাথে পয়সা খরচেরও একটা ব্যাপার থাকে কিনা..
যাই হোক, বহু লাফঝাঁপের পর বেলা দুটোয় বাড়ির পথে রওনা দিলাম। চীনে নববর্ষের ছুটিতে আবার আসা যাবে