Wednesday, February 27, 2008

এলোমেলো কথা - ০৫

১.
ইদানিং মন মেজাজ ভালো থাকেনা। ক্যারিয়ার টিফিন ক্যারিয়ার হয়ে গেল এই ভয়টা মাথার ভিতরে ফুলে ওঠে, তারপর দুম করে একটা বিস্ফোরন! সেদিন মনে হল দুই গ্যালন পেট্রল কিনে জ্বালিয়ে দেই। আরসেনিস্ট কেন হয় লোকে সেটা হাড়েমজ্জায় টের পাচ্ছি। ভাগ্যিস গাড়িটা ছিল তাই মাঝে মাঝে হারিয়ে যাওয়া যায়। সেদিন হারিয়ে গেলাম হঠাৎ। জিপিএসটা বন্ধ করে যেদিকে দুচোখ যায় মার্কা টান! দুঘন্টা পরে একটা ডেডএন্ডে হাজির। সামনে অদ্ভুত একটা সাইনপোস্ট, তাতে আঁকা একজন বন্দুক তাক করে দাড়িয়ে আরেকজনের দিকে। প্রাইভেট এরিয়া, ট্রেসপাস করলে ফুটুস? আমি দুঃসাহসী না, জিপিএস অন করে ছটফট করি কখন ফিক্স পায়...
আমরা হারিয়ে যাবার স্বপ্ন দেখি, সাহসটাই রাখিনা

২.
ক্যামেরন হাইল্যান্ডে গেলাম বেড়াতে এই চীনে নববর্ষের ছুটিতে। ঈদের ছুটিতে এই মুসলিম প্রধান দেশটা ঘুমায় না, কিন্তু গং সি ফাই চাই এর উৎসবকালে শহরটা দপ করে নিভে যায় কদিনের জন্য। টাকার নাম বাপজান, বাকি সব মায়ার খেলা...

চীনেদের আমার অদ্ভুত লাগে। নববর্ষে আমরা বলি শুভ নববর্ষ, এরা বলে গংসিফাচাই-"আপনি আরো সম্পদশালী হোন"! নববর্ষে এরা কমলালেবু বিলি করে, কথায় কথায় কে যেন বললো, কমলার রং সোনালী টাকার মতো, তাই এই ফল নিয়ে এতো বাহানা! বাহ! টাকাই ধর্ম টাকাই কর্ম টাকাই পরমেশ্বর-এই সত্যটাকে এতো আয়োজন করে আর কোন জাতি মনে হয় মাথায় তুলে রাখতে পারে না! উন্নতি কি এমনি এমনি হয়! বিয়েতে লাল খামে (আংপাও) ভরে টাকা দাও, জন্মদিনে মাস্তি করে খরচের টাকা দাও, নববর্ষে ছোটদের টাকা দাও... বাকি সব ফালতু..

যাই হোক, ক্যামেরন হাইল্যান্ড বিখ্যাত চা আর স্ট্রবেরী বাগানের জন্য। গরম দেশে এই মালভূমি খানিকটা শীতকে মনে করিয়ে দেয়। লোকে তাই ছুটিছাটায় দল বেঁধে বেড়াতে যায়। স্ট্রবেরী ক্ষেতে পয়সা দিলে ইচ্ছেমতো কোঁচর ভরে তুলে আনা যায়। মুগ্ধ জনতা পয়সা খরচ করে ঢুকে বিষম টক স্ট্রবেরী তুলে আনন্দে বাকবাকুম শুরু করে। আমাদের শখ থাকলেও সময় হল না। শখ ছিল দুনিয়ার সবচে' বড় ফুল রাফলেসিয়া আর্নোল্ডি দেখবার। ট্রেকিং করায় কিছু ফ্যাসাদ থাকায় সেটাও হল না!

৩.
বাংলাদেশের খেলা ছিল রোববার। বত্রিশ কিলো ড্রাইভ করে গেলাম ক্রিকেট স্টেডিয়ামে- আমি আর রিস্কি হামিদ। ওডিআই তাই একটু ধীরে সুস্থ্যেই গেছি। গিয়ে দেখি মাঠ খালি, চল্লিশ রানে অলআউট শার্দুল শাবকেরা কাছাখুলে বাড়ি ফিরে গেছে। দুপুরের খটখটা রোদ গভীর বিশাদে আশাহত একদঙ্গল বাংলাদেশী শ্রমিক দাড়িয়ে অপেক্ষা করেছে বাহনের জন্য...

৪.
আবার হারিয়ে গেলাম সেদিন। খিদে লাগলো যখন তখন হাজিরা দিলাম জনি'স স্টীমবোটে। গায়ে নিত্যউপহারের বাংলাদেশ টিশার্ট।

-"হয়ার আর ইউ ফ্রম সার?"
-আপনে বাংলাদেশের?
-জ্বী, ভাইয়া কি এইখানেই থাকেন
-হু, কবে আসছেন? বাকিরা কই? ওই যে ফর্সা মতো?
-মামুন ভাই? ওই যে, ভাইয়া মনে হয় প্রায়ই আসেন
এইখানে দেশের মানুষ খুব কম আসে
-ওই আর কি, আমি যা পাই তাই খাই

ছেলেটা সিলেটের। বয়স হয়েছে, শুধু চেহারায় কৈশোর দুষ্টু ছেলের মতো আটকে আছে। গভীর মনোযোগে সে আমার স্টীমবোট সাজায়। স্টীমবোটে ব্যাপক আয়োজন, ট্রেইনি হিসাবে তাকে কাজটা নিখুঁতভাবে শেষ করতে হবে

-কয় দিন হল?
-জুন আসছি
-কেমন লাগে
-খুব চাপ ভাইয়া, ভাইয়া বললাম রাগ করেন নাই তো, এইখানে সার বলার নিয়ম
-ধূর

ছেলেটা হাসে।
-সামনে সেপ্টেম্বারে দেশে চলে যাবো
-কেন? আরে কয়দিন থাকলে ঠিক হয়ে যাবে, কতো পড়লো আসতে?
-দুই লাখ
-জমে কিছু
মলিন একটা হাসি দিয়ে ছেলেটা টমইয়াম সুপ ঢালে হটপটে, সেই ঝোলে আমি খানিক পরে টুকরো টুকরো জেলি ফিশ চুবিয়ে চুবিয়ে খাবো।
-আমি চলে যাবো, থাকবো না এইখানে, মামুন ভাইও যাবে

আমি খানিকটা অপ্রস্তুত হই, কথা খুঁজে পাই না। উসখুশ করতে থাকি জেলি ফিশের টুকরো গুলোর জন্য। যতো তাড়াতাড়ি খেয়ে পালাতে হবে... পালাতে হবে

৫.
কোরিয়ান খাবার খেতে গিয়ে কিমচি জিনিসটা ভালো লেগেছিল। তার পয়সা খরচ করে সেবার ইসেতান থেকে দুবাটি কিমচি এনেছিলাম। রসুনমরিচ দিয়ে মাখানো বাঁধা কপি আধাপচা হয়ে গেলে তাকে বলে কিমচি, কোরিয়ার জাতীয় খাবার। সেদিন দেখি মিলিয়ন ডলার খরচ করে স্পেস কিমচি বানানো হয়েছে, স্পেস স্টেশনে কোরিয় নভোচারীর রসনা বিলাসার্থে। কিমচিতে ফার্মেন্টেড বলে প্রচুর ব্যাকটিরিয়া থাকে। বিজ্ঞানীদের ভয় ছিল মহাশূন্যের কসমিক রের প্রভাবে মিউটেট করে এরা বিপজ্জনক দানব টানব হয়ে যাবে। ব্যাকটিরিয়ার কারনে কিমচির গন্ধও বেশ খারাপ। তাই গন্ধদূরীকরনও আরেকটা লক্ষ্য ছিল। কোরিয়ান গবেষকরা সফলভাবে এই সমস্যার সমাধান করেছেন। কোরিয় নভোচারী মহাশূন্যে ডিগবাজী দিয়ে কিমচি খাবেন, আমরা পৃথিবীতে বসে হাততালি দেব! লা জওয়াব!!

৬.
সচলায়তন সংকলন বের হয়েছে। এই নিয়ে বেশকিছু অনেক হৈচৈ করেছি আমরা। বইটা বের হয়েছে শুনে ভীষন রাগ হল। ঘরের প্রথম শিশু, তাকে কোলে তুলে দেখতে পারবো না, এটা কেমন কথা। দুর্জনে কানাখোড়া বলে, তাই বলে কি মা তাকে ত্যাজ্য করে? আমার খুব লুকিয়ে দেখার শখ হিমু বইটা হাতে পেয়ে কি করে। আবলুশ কালো এই জংলীটার চোখ চিকচিক করে ওঠার দৃশ্যটা দেখতে আমার বড় ইচ্ছা করছে... বয়স কম হলে বইটা বালিশের নীচে রেখে ঘুমিয়ে পড়া যেত-বুকে জড়িয়ে ধরে সবাইকে দেখিয়ে বলা যেত এটা আমাদের বই, আমাদের বই.. একদম আমাদের বই..
কপাল, বড় হয়ে গেলে আমরা কতো ছেলেমানুষীই আর করতে পারি না...

1 comment:

  1. আপনার লেখায় একধনের বিষাদ লুকিয়ে থাকে। পড়তে ভালোই লাগে।

    ঘুরতে ঘুরতে এই ব্লগে এলাম।

    ReplyDelete

To comment in Bangla, please use Avro Keyboard Interface. Click here for Bangla Installation Guide.

বাংলায় লিখতে অভ্র কিবোর্ড ব্যবহার করুন. বাংলা ইন্সটলেশন গাইড পাবেন এখানে