Saturday, February 14, 2009

মুজিব মেহেদীর বইচুরি, সত্যজিতের কল্কিবাবা আর পিটার সেলার্সের বান্দর

মুজিব মেহেদীকে প্রথমবার দেখে চুপচাপ সজ্জন মানুষ বলেই মনে হয়েছিল (ভদ্রলোক শব্দটা ব্যবহার করা গেল না, এর আগে উনি আমাকে কঠিনভাবে নিষেধ করে দিয়েছেন)। এই লোকটার সাম্প্রতিক একটা পোস্ট পড়ে সেদিন মেজাজটা তিতা হয়ে গেল। দেশে বনভূমি হ্রাস পেলে এই হয়। বান্দরে গাছ না পেলে লোকালয়ে হাজির হয়। কলাটা, মুলোটার সাথে সুযোগ পেলে পান্ডুলিপিও মেরে দিতে দ্বিধা করে না।

যাই হোক, মুজিব মেহেদী স্বভাবতই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। থুতু মারতে চেয়েছিলেন তিনি। আমার বাবা হলে হয়তো ক্রিকেট ব্যাট হাতে নিয়ে কিছু করে বসতেন। মুজিব মেহেদীকে ক্রোধ সংবরনের জন্য তাই সাধুবাদ দিতেই হয়। মুস্কিল হল, পান্ডুলিপি মারা আর থুতু মারার মধ্যে কোনটা গুরুতর অপরাধ সেটা নিয়ে মাঝখান থেকে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়ে গেছে। কপাল! থুতু মারার বিষয়টা আসলে কোন প্রাণীই সহজভাবে নিতে পারেনা...

যাই হোক, ফেরা যাক মূল গপ্পে। ষাটের দশকে সত্যজিৎ রায় একটা গল্প লিখলেন সন্দেশে, নাম "বঙ্কুবাবুর বন্ধু"। গল্পে একটা ভারতীয় ব্যবসায়ীর চরিত্র ছিল। সত্যজিতের খায়েস ছিল পিটার সেলার্স (ক্লাসিক পিঙ্ক প্যান্থার খ্যাত) করবেন এই চরিত্রটি। (সেলার্সের কঠিন দক্ষতা ছিল ইম্পার্সনেশনের। অবলীলায় কৌতুক করতে পারতেন ইন্ডিয়ান, জার্মান কিংবা ফ্রেঞ্চ অ্যাকসেন্টে)। সত্যজিতের ইচ্ছা ছিল সিনেমা হবে হলিউডে, বিশেষত স্পেশাল ইফেক্টের প্রয়োজনে। ১৯৬৬ সালে সত্যজিৎ তার খায়েস জানান বন্ধু আর্থার সি. ক্লার্ককে। ক্লার্কের সূত্রে তার পরিচয় ঘটে চিত্রপ্রযোজক ও নির্মাতা মাইক উইলসনের সাথে। মাইক উইলসন সেসময় সিংহলী দর্শকদের জন্য (ক্লার্ক আর উইলসন দুজনেই শ্রীলঙ্কায় থাকতেন) গভীরাগ্রহে জেমস বন্ডের নকলে "জেমস বান্দা" নামে সস্তা মুভি বানাতে ব্যস্ত ছিলেন (জেমস বন্ডাইলের কথা মনে পড়ে গেল!)।


দ্য পার্টিতে ভুরুন্ডী বক্সীর চরিত্রে পিটার সেলার্স

সত্যজিতের খায়েস শুনে উইলসন রাজী হয়ে গেলেন। ভদ্রলোক এতোই রাজী হলেন যে আঠার মতো লেগে গেলেন সত্যজিতের পিছে। বললেন, চিত্রনাট্য লেখার সময় পাশে থাকতে চান, প্রয়োজনে কফি বানিয়ে খাওয়াবেন তাকে। সত্যজিত মনে মনে ব্যপক বিরক্ত হয়েছিলেন। তিনি নিরালায় লেখেন, পাশে একটা উটকো যন্ত্রনা বসে থাকবে সেটা তার পছন্দ হয়নি। উইলসন ঠিকই বসে ছিলেন, কফি বানিয়ে দেননি, কিন্তু খানিক পরপর আইডিয়া ছুড়ে ছুড়ে সত্যজিতের মাথার পোকা নাড়িয়ে দিতে বাদ রাখেননি।

দু'হপ্তা পরে সেই চিত্রনাট্য লেখা শেষ হল। নাম ঠিক হল, দ্য এলিয়েন। কলাম্বিয়া পিকচার্স রাজী হল ছবি করতে। কিন্তু সত্যজিৎ কদিন পরে জানলেন চিত্রনাট্যের জন্যে দেওয়া দশহাজার ডলার উইলসন মেরে দিয়েছেন। ইতোমধ্যে চিত্রনাট্যের কপি ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন জায়গায়। দেখা গেল সেখানে সত্যজিতের পাশে উইলসনের নাম। এক পর্যায়ে সত্যজিত ভাবলেন চোরা উইলসনকে ছাড়াই ছবি করবেন, স্বত্ত্ব ত্যাগ করতে বললেন উইলসনকে। পাল্টা তাকে "চোর" বললেন উইলসন। মনের দুঃখে "দ্য এলিয়েন" না নির্মানের সিদ্ধান্ত নিলেন ফেলুদার বাবা।

তারপর ১৯৮২ সালে স্পিলবার্গ বানালেন, "ই.টি."। আর্থার ক্লার্ক টেলিগ্রাম করলেন সত্যজিতকে। তিনি জানতেন এটা চুরি, বললেন মামলা করতে। সত্যজিত লেবু কচলাকচলিতে যাননি। মাঝখান থেকে স্পিলবার্গ অস্কারে ৯টা নমিনেশন আর ৪টা পুরস্কার জিতে নিলেন। চিত্রনাট্য চুরির কথা বলায় ভদ্রলোকের বক্তব্য ছিল "চিত্রনাট্য যখন হলিউডে চইড়া বেড়াইতেছিল, তখন আমি পুলাপান আছিলাম.."

জানা যায়, উইলসন উত্তরজীবনে বিষ্ণুভক্ত হয়ে পড়েন। নতুন নাম নেন স্বামী শিবকল্কি। এবং শেষ পর্যন্ত চিত্রনাট্যের স্বত্ত্বত্যাগ করেন। কিন্তু ততোদিনে অনেক পানি গড়িয়ে গেছে।


স্বামী শিবকল্কি (উইলসন)

যাই হোক, গল্পের আরেকটু বাকি আছে। মহামতি পিটার সেলার্স চিত্রনাট্য পড়ে খুব বেশী খুশি হননি, তার দাবী ছিল তার চরিত্রটাকে আরো গুরুত্ব দিতে হবে। রায়সাহেব সেই আব্দারে পাত্তা দেননি। এর ফল খুব ভালো হয়নি। সেলার্স ব্যস্ত ছিলেন "দ্য পার্টি" নির্মানে। সত্যজিতের উপর ক্ষেপে গিয়ে ভুরুন্ডি বক্সীর (সিনেমায় সেলার্সের চরিত্র) পোষা বান্দরের নাম রাখলেন "অপু"!!!

বিনয় আর মহানুভবতা ধুয়ে পানি খাওয়া যায়, কিন্তু তাতে যে শরবত হয়না সেটা সত্যজিৎ মনে হয় জানতেন না.. বেচারা রায়সাহেব..

লেখক মুজিব মেহেদীর সৌভাগ্য, এটা ১৯৬৭ না। এখন আর শাক দিয়ে মাছঢাকা যায় না। মাছেদেরও ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থাকে। তারাও msn, sms এ বার্তা পাঠায়। ২০০৯-এ এসে আইনের ফাঁক গলে চোর ফসকে যাক বা না যাক, লোকে এখন জানে কার মায়ের বড় গলা।
আমরা ত্রাণের টিন থেকে খাম্বা পর্যন্ত চুরি করেছি।

বইচুরি করাটা কি এতোই জরুরী ছিল?


এইটা যদি আধুনিক ঈশপের গল্প হয় তাহলে আমরা যাহা শিখিলামঃ

০. চোরকে "চুর" বলিলে পাল্টা "চুর" অ্যাখ্যা পাইবার আশংকা থাকে

১. চুরি ধরার পরপরই সাইজ না করিলে গুড় সব চুরায় খায় (কপাল ভালো থাকলে দুই-একটা অস্কারও পাইয়া যায়)

২. আজিকার তস্কর, আগামীর কল্কিবাবা

৩. বান্দররে চটাইলে, হে তার পুলাপানের নাম দিবো আপনের নামে

.............................................................
পুনশ্চঃ এই লেখা প্রকাশের পরে রাস্তাঘাটে কেউ যদি তার পোষা বানরকে "অরূপ" নামে ডাকে, তাহলে অবাক হবেন না। বরং তাকে দয়া করে দুইটা টাকা দিতে পারেন। পোষা বানরদেরও পুষ্টির প্রয়োজন...

ফাওঃ দ্য পার্টিতে সেলার্স

এই লেখার রসদ এসেছে যেসব যায়গা থেকে
http://www.ultrabrown.com/posts/satjayit-ray-peter-sellers-and-aliens
মুহম্মদের পোস্ট
দ্য আনমেড রে
http://en.wikipedia.org/wiki/The_Alien

No comments:

Post a Comment

To comment in Bangla, please use Avro Keyboard Interface. Click here for Bangla Installation Guide.

বাংলায় লিখতে অভ্র কিবোর্ড ব্যবহার করুন. বাংলা ইন্সটলেশন গাইড পাবেন এখানে