১.
ইমিগ্রেশন পার হয়ে গ্রীন চ্যানেল দিয়ে বের হবার নিয়ম, আমি খানিকটা থমকে দাড়াই, কাঁচের দেওয়ালের ওপাশে কারা দেখবার জন্য। বয়স কম হয়নি, দূরে তাকালে সব কেমন ঘোলা ঘোলা লাগে। পেছন থেকে কেউ যেন তাড়া দেয়, হ্যান্ডক্যারিটা নিয়ে আমাকে এগুতেই হয়। হঠাৎ একটা হাত দেখে থামি, এটাই বাবা। আমি জানি এরপর আমাকে কোথায় যেতে হবে। খাকি শর্টস আর লাল পোলো শার্ট পড়া বছর ত্রিশের "ছোটছেলে"টা বাবার দিকে দৌড় দেয়।
একটা শিশু বিশালতা জিনিসটা শেখে সম্ভবত বাবার কাছ থেকে - সাহসের বিশালতা, জ্ঞানের বিশালতা, ব্যক্তিত্বের বিশালতা কিংবা ক্ষমতার। বাবার কাছে গিয়ে আমি তাই ধাক্কা খাই, ডায়াবিটিসের কল্যাণে আমার বিশাল বাবাটা কেমন ছোটছোট হয়ে গেছে, কপালটা আরও বড় হয়েছে, আরেকটু পাতলা হয়ে গেছে সাদা চুলগুলো। শরীর ক্ষয়ে যেতে পারে, মন কি দুর্বল? আমি জানি বাবা সেটা প্রকাশ করবেন না, বাবাদের বইয়ে দুর্বল হওয়াটা নিষেধ, এই আইনটা ভদ্রলোক নিয়ম করে মেনে চলেন।
"কেমন আছ কামাল সাহেব?"
"হাফপ্যান্ট দেখেই বুঝছি তুই", খানিকটা গর্বের সাথে বলে ওঠে বাবা। বেচারা ভোর ছটায় এসেছে, থাকতে হবে আরো ঘন্টা দুয়েক, ওদিকে জেষ্ঠ্যপুত্র আসছেন প্রায় বছর আটেক পর।
দুটো কফি নিয়ে আমরা দুজন বসি আরেকজনার অপেক্ষায়। ক্লান্তিতে ভেঙ্গে পড়তে পড়তে আমি বিস্ময়ে দেখতে থাকি কি গভীর আগ্রহেই না সত্তর ছুইছুই লোকটা গ্রীন চ্যানেলের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। ভালোবাসা, স্নেহ এই অনুভূতিগুলো কতোই না অদ্ভুত!!!
২.
ছোটবেলায় মার খেয়েছি প্রচুর, তবে দীর্ঘ সময় বিদেশ থাকায় বাবার কোটাগুলো মা সার্থক ব্যবহার করেছেন।
কেমন মানুষ ছিলেন? অদ্ভুত..
নিউ মার্কেটে যাবার আগে প্রতিজ্ঞা করাতেন খেলনার জন্য বায়না করা যাবেনা, যদিও প্রতিবারই বাড়ি ফেরা হতো নতুন একটা কিছু হাতে নিয়ে, তা গল্পের বইই হোক আর গেইমএন্ডওয়াচই হোক।
মেঝমামাকে একবার কঠিন ধমক দিয়েছিলেন আমাকে ছোটবেলা ফোটোগ্রাফি কেন শেখানো হচ্ছে বলে! নিজে বয়স্কাউটে থাকলেও আমার বেলায় বড় বাগড়া দিতেন!! আমার ভাইকে কম্পিউটার কিনে দেবার জন্য পাগল ছিলেন, আমি প্রোগ্রাম লিখলে তেমন গা করতেন না
এই নিষ্ঠুর লোকটাই আবার আমার বন্ধু, আমার সাহস, আমার সমস্ত ভরসা। মনে আছে মাশীদের সাথে দেখা করার জন্য চুপি চুপি পালাতে গেলেই জিজ্ঞেস করতেন পয়সা লাগবে কিনা। একটা সময় ছিল যা চাইতাম তাই কিনে দিতেন (যদিও বেশী চাওয়া যেত না কারন মা বিবেক হিসেবে দৃশ্যপটে হাজির হতেন)
জীবন সবসময় সুখের ছিলনা। ধাক্কা খেতে হয়েছে অনেকবার। পিছলে পড়ছি, বাবা হাত ধরেছেন।
এমন কিছুই করিনি জীবনে, তারপরও বাবা অসম্ভব গর্বভরে বলেন তার পুত্রদ্ধয়ের কথা। মাশীদ খানিকটা অবাকই হয়, আমি ভাবি, আমিও কি একই গর্বাপ্লুত স্বরে সন্তানগাঁথা গেয়ে যাব কিনা..
৩.
ঢাকায় গেলেই বাবা এটা সেটা কিনে দেবার কথা বলেন। আমি বিনা বাক্যব্যয়ে সাথে যাই। জুতো লাগবে না, তারপরও একজোড়া কেনা হয়ে যায়, আমি জানি, বাবাকে এই সুযোগটা দিতে হবে। বায়না ধরে বড় হওয়া ছেলেটা যখন আর বায়না ধরেনা তখন বাবাদের কেমন লাগে আমি অনুভব করার চেষ্টা করি। ভীষন অস্বস্তিকর সেই ভাবনা...
৪.
বাবার কাছ থেকে ছেলেরা অনেক কিছু পায়। আমি লোকটার সততার কিছুই পাইনি, পাইনি সাহস কিংবা কঠিন ব্যক্তিত্ব। ডাঁকসাইটে খেলোয়ারের ছেলে হয়ে আমি স্পোর্টস চ্যানেলে ঢুকিনা কখনই (খেলা তো দূরের কথা)
কিন্তু লোকটার কাছে আমার অপরিসীম কৃতজ্ঞতা। আরজ আলী মাতুব্বরকে চিনেছি বাবার কাছ থেকে। নিয়মকে প্রশ্নকরা কিংবা নতুনকে গ্রহন করার যে সামান্য প্রবনতা সেটাও তারই দান। তবে সবচে বড় প্রাপ্তি মনে হয় বিশাল নাকটা আর মেজাজ। বাবাকে কখনও প্রশ্ন করা হয়নি, কেমন লাগে যখন সে দেখে আমরা তাকে দেহমনআচরনে বহন করে করে বড় হচ্ছি।
৫.
ঢাকায় ফোন করলাম কয়েকবার, লাইন পাওয়াটা কঠিন। পোস্টটা করে হয়তো আবার চেষ্টা করবো। সেই আলাপে অনেক কথাই হয়তো হবে। কোন একটা কারনে বাড়তি আবেগটুকু মুছে আমরা কথা বলি। আজকে ভীষন বলতে ইচ্ছা করছে "ভালো থেকো বাবা, আমার বড় ভয় করে"। আমি জানি আমি কথাগুলো বলবো না..
কতো সহজ কথাই এই জীবনে আমাদের বলা হয় না আর..
বাষ্প..
ReplyDelete