(লেখাটা বহুদিন হল ঝুলে আছে, ব্রঙ্কিয়াল ইনফেকশনে পড়ে সব চুলোয় উঠেছিল, আজকে তাই হিসেব চুকিয়ে ফেলা যাক)
ব্রাজিল, লাতিন আমেরিকা নিয়ে আমার অনেক রকম ধারনা ছিল। কিন্তু বাস্তবতা ধারনাকে চারআনার পাত্তা দেয়না। পেলের দেশে গিয়ে রাস্তাঘাটে সাদাচামড়ার মানুষ দেখতে বেমানান লাগছিল। ইতিহাস পড়ে জানলাম আদিবাসী বা মাটির মানুষ যারা ছিল তাদের পর্তুগীজ শাসকেরা মেরে কেটে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে ফেলেছেন! প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছিল ওয়াইমিরা বলে একটা আদিবাসী গোত্র। ব্রাজিলের জেনারেলরা তখন আমাজনের মাঝ বরাবর রাস্তা বানাতে ব্যস্ত। আদিবাসী গোত্রের ঝামেলা তাদের বিরক্ত করল, মশামাছি মারার মতো তাই একরাতে হাজার দুয়েক মানুষকে মেরে এরা রাস্তা তৈরির পথে আর কোন বাঁধা অবশিষ্ট রাখলেন না।
যাই হোক, মূল গল্পে ফিরি। শনিবার সকালে ক্রিসের সাথে রওনা দিলাম MASP বা Museu de Arte de Sao Paulo এর দিকে। এই মিউজিয়ামকে নিয়ে আমার ব্যপক আগ্রহ। এই প্রথম সামনাসামনি বড় শিল্পীদের ছবি দেখার সুযোগ হবে। ছবি সামনাসামনি দেখলে আদৌ বেশী কিছু দেখা যায় কিনা আমার জানা নেই, তারপরেও দাপাদাপি উত্তেজনা।
১৯৪৭ এর তৈরি এই মিউজিয়ামটা অ্যাভেনিউ পলিস্তার একপাশে। বাইরে থেকে দেখলে বোঝবার জো নেই! দুটো লেভেল, লেভেল টুতে স্থায়ী প্রদর্শনী, আর লেভেল ওয়ানে সাময়িক প্রদর্শনী। লিফ্ট নিয়ে গেল লেভেল টুতে। লিফ্টে থেকে নেমে প্রথমেই অবাক হবার পালা, দালির একটা স্কেচ, ক্যাভালিয়ের। এলোমেলো দ্বিধাহীন কিছু রেখায় আঁকা সেই ঘোড়সওয়ার, ভদ্রলোকের বিখ্যাত কোন ছবি নয়, আমি অবাক হয়ে দেখতে থাকি সেই বলিষ্ঠ রেখাগুলো..
এই জীবনে আর্ট মিউজিয়াম দেখিনি আগে, ব্রিটিশ মিউজিয়ামে যাবার শখ থাকলেও কাজের চাপে আর যাওয়া হয়নি। সাও পাওলো মিউজিয়াম চট করে ভালো লেগে গেল একটা কারনে, ছবি গুলো সময় ও স্টাইল অনুযায়ী আলাদা করে রাখা, সাথে নোট। নোট পড়ে নিলে চিত্রকলার জগৎ ও দর্শন কিভাবে পরিবর্তিত/বিবর্তিত হয় সেই বিষয়টা পরিস্কার হয়, ফলে ছবি উপভোগ করাটা অনেক সহজ হয়।
উদাহরন দেওয়া যাক, একদম শুরুতে ছবির মানুষরা সটান শক্তপোক্ত দাড়িয়ে থাকতেন। ক্রমেই এতে পারস্পেকটিভ যুক্ত হল, সটান শক্ত মানুষগুলো আরেকটু সহজ হয়ে বেঁকে বা হেলে দুলে পোজ দিতে শুরু করলেন। ছবির সাথে যখন এরকম চমৎকার বিশ্লেষন থাকে তখন ছবি দেখা অনেক উপভোগ্য হয়ে ওঠে, নিঃসন্দেহে!
অনেক বিখ্যাত শিল্পীর ছবি ছিল যাদুঘরে, এদের মধ্যে পিকাসো, ভানগোহ, রাফায়েল, রেমব্রান্ড, রেনোয়া, মনে, মানে, সেজান, দেলাক্রোয়া উল্লেখযোগ্য। তবে এটাও বলতে হবে যে, যাদুঘরের কীর্তিগুলো সেরা শিল্পীদের সেরা কর্ম নয়। দুজন শিল্পীর ছবি একটু আলাদা করে টেনেছে, প্রথম জন হলে সান্দ্রো বত্তিচেল্লী। বত্তিচেল্লীর নারীদের নিয়ে কবিতা পর্যন্ত লেখা হয়েছে। বার্থ অফ ভিনাস বহুদিন ওয়ালপেপার ছিল আমার কম্পিউটারে। বত্তিচেল্লীর কন্যাদের সামনা সামনি দেখার সুযোগ কি হারানো চলে?
ছবিটার নাম শিশুসন্ত জন বাপ্টিস্টের সাথে কুমারী মেরি।
দ্বিতীয় ছবিটা দেখলে আমার ধারনা আরো অনেক সচল একটু হলেও পুলকিত হতেন, শিল্পীর নাম জাকাপো তিনতোরেত্তো, মৃত্যূপথযাত্রী যিশুর ছবি। মনে পড়ে সত্যজিতের "টিনটোরেটোর যিশু"? এই সেই শিল্পী..
যাই হোক, আরেকটা ছবির গল্প না বললে মিউজিয়াম কাহিনী অসম্পূর্ন থেকে যায়। ছবিটা পিকাসোর, নাম Portrait of Suzanne Bloch, ১৯০৪ এ আঁকা। পিকাসোর "ব্লু পিরিয়ড" এর অন্যতম কীর্তি।
২০০৭ এর ২০শে ডিসেম্বর আরেকটি ছবির সাথে এই ছবিটাও চুরি যায়। চোরেরা মাত্র তিন মিনিট সময় নেন চুরি করতে। মাস খানেক পর এই ছবিটি আবার উদ্ধার করা হয়। ছবিটার দাম খুব বেশী ছিল না, মাত্র ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার...
ঘরের কোনায় দাড়িয়ে যখন রঁদ্যার একটা ভাস্কর্য দেখছি, তখন ইয়ের ভাই ক্রিস এসে হাজির। শালার চীনেটা বহুক্ষন ধরে ঘ্যানঘ্যান করছে, আর্ট মিউজিয়াম তোর সয় না, তো আসিস ক্যান সাথে? বললাম লেভেল ওয়ান দেখে নীচে নামবো। ব্যাটা বিরস বদনে নীচে গেল। লেভেল ওয়ানে নতুন চীনে শিল্পীদের এক্সিবিশন চলছিল। চট করে দেখে নামলাম ছাগলটার খোঁজ নিতে। ছাগলের শখ হয়েছে ব্রাজিলিয়ান ম্যাক খাবে, তার ধারনা ব্রাজিলের মাংসের ম্যাকের স্বাদ আলাদা। কি যন্ত্রনা! শেষে টেনে নিয়ে গেলাম আগের দিনের রেস্তরায়।
খেয়েদেয়ে ক্রিসকে বলি, কই যাবে হে?
ইবিরাপুয়েরা পার্ক, সে বলে। পার্ক প্রায় দু মাইল দুরে, শালা হেটে হেটে যাবার ধান্দা করছে। বললাম ট্যাক্সি নিতে। সে মানবে না। মহা যন্ত্রনা, ভরদুপুরে ভরাপেটে এই বান্দরের সাথে আমি হাটতে রাজী না। "আমি তাহলে জু-তে যাই, তুমি পার্কে যাও গে", আমি বলে ফেলি
বদমাশটা ছোট চোখ আরো ছোট করে তাকায়। তারপর ওকে বলে হাটা দেয়। ট্যাক্সি নেব নিচ্ছি করছি, এমন সময় ক্রিসের দেখা আবার।
"কি চাস বাবা?"
"আমি রাস্তায় জিজ্ঞেস করলাম জু-তে যেতে কতোক্ষন লাগে, বলল ৪০ মিনিট তাই ব্যাক করলাম, আমার ধারনা ছিল জু-তে যেতে ২০০/৩০০ রিয়াইস লাগবে"
"চল চান্দু চল", দাঁত কিড়মিড় করে বলি আমি।
সাও পাওলো জু বিশাল, ট্র্যাভেল গাইডেও সুনাম করা। কিন্তু কিছুক্ষন ঘোরাঘুরির পর আমরা কিছুটা বিরক্ত হয়েগেলাম। আমাজনের পশুপাখি দেখার জন্যই আসা, সেখানে সাইবেরিয়ান টাইগার আর হাতি দেখলে ভালো লাগে না। ধারনা ছিল ভালো অ্যাভিয়ারি থাকবে, তাও নেই।
বিকেল ৫টার দিকে কিঞ্চিত বিরক্তি নিয়ে ফিরে এলাম আমরা দুজন।
আসার পথে রাস্তা দেখতে দেখতে আসি। সিগনালে গাড়ি থামে, এগিয়ে আসে ভিখারী কিশোর। দেখি ঠেলাগাড়ি ওয়ালা, আইল্যান্ডের উপরে বস্তি, তাতে হামাগুড়ি খাওয়া শিশু। সীমানা বদল হয়, ভাষা বদল হয়, দারিদ্রের চেহারা সেই একই থাকে। মুর্শেদের চিকিতা বিষয়ক কৌতুহলে ক্যামেরা বাগিয়ে থাকি। কিটিস কিটিস করে শাটার পরে, নারীমুখের ভান্ডার তৈরি হয় এসডি কার্ডে। ফিরে এসে যখন সেই ছবি দেখি তাতে মোহনীয় জেল্লার চেয়ে রোদেপোড়া পরিশ্রমী কিছু মুখ ভেসে আসে, মুর্শেদের চিকিতাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না।
রোববার কি করা যায়? দেখা গেল সাধ্যের মধ্যে করার তেমন কিছু নেই এক সমুদ্র সৈকত দেখা ছাড়া। সকালে উঠে মুড়িওয়ালার আসার বসে রইলাম। ব্যাটা শেষ মুহুর্তে বলে সে যাবে না, বুঝলাম অনেক দিন পর আয়েস করে ঘুমাবার সুযোগ সে ছাড়তে চায় না। কনসিয়ার্জকে জিজ্ঞেস করলাম সৈকত দেখার তরিকা। সে ম্যাপট্যাপ এঁকে দিয়ে সব বুঝিয়ে দিল। মেট্রো ধরে আমার গেলাম সাও পাওলো শেষ প্রান্তে জাবাকুয়ারা স্টেশনে। সেখান থেকে বাসে ৮৫ কিলো যাবার পর পৌছালাম গুয়ারুজা শহরে। তারপর ট্যাক্সি নিয়ে এনসিয়েদা সৈকতে। এনসিয়েদা জনপ্রিয় সৈকত, প্রচুর ঢেউ, কিন্তু পানি স্বচ্ছ না। না, এখানে টপলেস সুন্দরী ছিল না। ব্রাজিলের খুব সীমিত সৈকতে টপলেস সুন্দরীদের দেখা যাবে, তার সবই রিও-তে। তাই যারা ভাবছিলেন অরূপ কঠিন দাও মেরেছে, তাদের আশার গুড়ে বালি।
এনসিয়েদা সৈকত খুব সুন্দর না হলেও এর আকর্ষন প্রাণ চাঞ্চল্যে। সৈকত ভর্তি এতো মানুষ দেখলে কেমন মেলা মেলা ভাব চলে আসে।
সাধারন কাপড়েই সৈকত ধরে হাটতে থাকি, হাতে কায়দা করে ক্যামেরা ধরা যেন অলক্ষ্যে শাটার টেপা যায়।
এমন সময় একটা 'সাদা' শিশু দৌড়ে আসে, পর্তুগীজে কি যেন বলে হাসি মুখে। প্রথম খানিকটা ভয় পাই! ফকির নাকি? মাথা ঝাকাই, তোদের ভাষা পারি না রে পিচ্চি। একটু পরে একঝাঁক বাচ্চা মেয়ে এসে ঘিরে ধরে। খিলখিল করে কি যেন বলে। আমি লাজুক হাসি দিয়ে আগে বাড়ি। কিছুদূর যেতেই আবার সেই বালক.. এবার মনযোগ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করি, আই ভিনসেন্জো। তারপর আমাকে জিজ্ঞেস করে, হোয়াট ইজ "মাই" নেম? একটু আগে সম্ভবত সে শিখে এসেছে কারো কাছ থেকে। "ইওর" এর জায়গায় "মাই" বসিয়ে ফেলেছে ভুল করে।
আমি হ্যান্ডশেক করে নাম বলি। ছেলেটা বিপুল আনন্দে খুশি হয়ে ফিরে যায়।
ধীরে ধীরে বিষয়টা পরিস্কার হয়। মুড়িওয়ালা বলেছিল ব্রাজিলে ইন্ডিয়ান (বাংলাদেশও এতে পড়ে কিনা) চেহারার মানুষের আলাদা কদর। আমরা যেমন সাদা চামড়া দেখে টাসকি খাই এরা ভারতীয় উপমহাদেশের শুনলে আরো টাসকি খায়। কি অবিশ্বাস্য!!!! দুনিয়ায় তাহলে একটা দেশ আছে যেখানে আমার চামড়া কোন সমস্যা না??
আবেগ তাড়িয়ে আবার মন দেই, মুর্শেদের চিকিতা খোঁজায়। ইশপের শিক্ষা, চিকিতারা শুধু টেলিভিশনেই থাকে, বাস্তবে না
কিছু ছবি দেই। মন ভরে দেখে নেন যা দেখার
যে যেটায় খুশি
গুয়ারুজার মেয়ে
ভালোবাসা ভারী!
যুগল
মারমেইড বানাতে ব্যস্ত যুবকের দল
উল্টো সাইনবোর্ডের রাস্তা, এই রাস্তায় সব সাইনবোর্ড উল্টো!
-------------------------------
ফেরার পথে রাস্তায় প্রচুর ফাভেলা দেখলাম। ফাভেলা অনেকটা বস্তির মতো, ঢাকায় যেভাবে চুরি করে বিদ্যূৎ নেয়, ফাভেলাতেও তেমন করে। কি অদ্ভুত! এতো বিশাল দেশেও মানুষের আশ্রয়ের সমস্যা!
দেখতে দেখতে ফেরার দিন চলে এলো। তিন তারিখ রাত একটায় ফ্লাইট, মুড়িওয়ালা এলো এয়ারপোর্ট পর্যন্ত। মন খানিকটা খারাপই। মুড়িওয়ালার সাথে একটা আলাদা সম্পর্ক। বেচারার বাড়িতে যাওয়া হল না, শখ ছিল রেঁধে খাওয়াবো। কাজের চাপে আর হয়নি। মুড়িওয়ালায় খুব আশায় আছে আমাদের প্রজেক্টে ঢোকা নিয়ে। বেচারা একা পড়ে গেছে এই জঙ্গলে। শেষ একটা সিগারেট ফুঁকে আমি বোঁচকা হাতে ঢুকে যাই। ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে থাকে মুড়িওয়ালার চেহারাটা। এমিরাতসের মিষ্টি মেয়েটা সবঠিকঠাক করে দেয়।
বোর্ডিং পাস হাতে নিয়ে বলি, "ওব্রিগাদো.."
না নাজানা মেয়েটাও কিছুবলে প্রত্যুত্তরে। আমি হাসি, সেও হাসে। পা বাড়াই, সিকিউরিটি পার হই, ইমিগ্রেশন পার হই। ঝকঝকে একটা বোয়িং ৭৭৭ অপেক্ষা করে আছে। গুয়ারুলঅস এয়ারপোর্টের দিকে শেষবারের মতো তাকিয়ে মনে মনে বলি, "থ্যাংক ইউ সাও পাওলো! কতোই না দেখার ছিল এ জীবনে!"।
No comments:
Post a Comment
To comment in Bangla, please use Avro Keyboard Interface. Click here for Bangla Installation Guide.
বাংলায় লিখতে অভ্র কিবোর্ড ব্যবহার করুন. বাংলা ইন্সটলেশন গাইড পাবেন এখানে।