Saturday, September 1, 2007

মালাক্কায়..

গাড়ি কেনার আগে থেকেই ইচ্ছা ছিল ড্রাইভ করে মালাক্কায় যাব। আমার বাড়ি থেকে সোজা সেরেম্বান হাইওয়ে ধরে দক্ষিনে দুঘন্টা গেলেই মালাক্কা (Melaka)।

শুক্রবার রাতে ভীড়ভাট্টা বেশী, তাই শনিবার রওনা দিলাম (২৫ অগাস্ট)। ঘুম থেকে সকালে উঠি না, তাই বেরুতে বেরুতে ১টা আর পৌছালাম তাই ৩টার দিকে। পুসাত বান্দারায়া (সিটি সেন্টার) পৌছাতে কষ্ট হল না, ছোট্ট ছিমাছাম একটা শহর। মুস্কিল হল পার্কিং নিয়ে। কোথাও জায়গা না পেয়ে "দাতারান পালোয়ান" মেগামলের সামনের রাস্তার অন্যদের দেখাদেখি গাড়ি রাখলাম। কাজটা যে ঠিক হয়নি সেটা বুঝতে পেরেছি ঘন্টা তিনেক পরে।

Stadhuys Building, মালাক্কা
Stadhuys Building, মালাক্কা

"দাতারান পালোয়ান" মেগামল, মল হিসেবে ক্লাস ওয়ান, এবং দীর্ঘ ভ্রমনের পর ক্লাস ওয়ান মলের ধারে পাশে থাকলে টয়লেটে ঘুরে আসা অবশ্য কর্তব্য! মল থেকে বের হয়ে আমরা হাটা দিলাম সেন্ট পল এর গীর্জার দিকে। ওদিকটা সবসময়ই জমজমাট থাকে। মালাক্কা মিউজিয়ামের শহর, প্রায় ডজন দুয়েক মিউজিয়াম আছে এখানে! মরার রয়াল কাস্টমসও একটা মিউজিয়াম খুলে বসে আছে! সেন্ট পল এর গীর্জা একটা ছোট টিলার উপরে গড়া। ১৫২১ সালে দুয়ার্তে কোয়েলো গীর্জাটি নির্মান করেন। গীর্জার ভেতরে একটা ছোট সমাধিক্ষেত্র আছে। উচু জায়গায় বলে পুরো মালাক্কার একটা চমৎকার ছবি দেখা যায়।

সেন্ট পলস্ থেকে নেমে সমুদ্র ধরে হাটতেই চোখে পড়ল পুরোনো পর্তুগীজ জাহাজ। জাহাজটাকে রেনোভেট করে মিউজিয়াম বানানো হয়েছে, কিন্তু সংস্কারের কাজ চলছিল বলে ঢোকা গেল না।

ম্যাপ দেখে ঠিক সুবিধা করতে পারছিলাম না, হাতে ট্র্যেকিং জিপিএস থাকায় রাস্তা হারাচ্ছিলাম না কিন্তু কিছু খুজেও পাচ্ছিলাম না। তাই ৪০ রিঙ্গিত ঘন্টা হিসেবে রিক্সা ভাড়া নিলাম। গন্তব্য চায়না টাউন, স্পেশালী জংকার স্ট্রীট। রিক্সাওয়ালা গাইড হিসেবও কাজের, নিয়ে গেল বাবা-নিয়োনইয়া ঐতিহ্য দেখাতে। চীনারা মালে মেয়েদের বিয়ে করে নতুন একটা অনন্য, সংকর কৃষ্টি তৈরি করে যা পরে বাবা-নিয়োনইয়া (Baba-Nyonya) কৃষ্টি হিসেবে পরিচিত। বাবা-নিয়োনইয়া ঘরানার খাবার বেশ বিখ্যাত। স্বাদ নিতে গেলাম রেস্তোরান ন্যান্সী'স-এ। খাবারে মিস্টি ভাবটা কম থাকলে অসাধারন বলা যেত নির্দ্বিধায়। জংকার স্ট্রীটে পৌছে দেখি চারদিকে পাইনাঅ্যাপল টার্ট এর পসরা। পাইনাঅ্যাপল টার্ট মালাক্কার আরেক আকর্ষন, পর্তুগীজদের থেকে পাওয়া এই জিনিস গরমাগরম খাবার মজাই আলাদা। টুরিস্ট প্রচুর বলে এখানে অ্যান্টিক আর ক্র্যাফ্টস এর দোকান প্রচুর। মাশীদ লটকে গেল সেসব দেখতে, সেই ফাঁকে আমি গেলাম গাড়ির খবর নিতে। গিয়ে দেখি ৩০ রিঙ্গিত ফাইন করেছে পার্কিং টোকেন কিনিনি বলে! যাই হোক পরের দিনের টোকন কিনে মাশীদের খোজে রওনা দিলাম। শুনেছিলাম "উজাং পাসির" এর রাস্তা ধরে গেলে পর্তুগীজ ভিলেজ পড়বে, কয়েকবার হারানো পরে আমার হাজির হলাম শেষপর্যন্ত। তবে জেনুইন পর্তুগীজ খাবার খুজে পাওয়া মুস্কিল! খিদে না থাকায় ফের জংকার স্ট্রীটে, তবে তার আগে হোটল নিতে হবে। হোটেল পুরী ভারি চমৎকার একটা হোটেল, কিন্তু ভাড়া ২২০ এর মতো। সামনে একটু দূরেই বাবা হাউসের ভাড়া ৯৫ রিঙ্গিত সাথে ব্রেকফাস্ট আর পার্কিং। দেরী না করে একটা ঘর নিয়ে দৌড় দিলাম জংকার স্ট্রীটের নাইট মার্কেটে। পাসার মালাম (নাইট মার্কেট)হিসেবে বেশ ভালো বলতে হয়, কাঁচা বাজারের বদলে অ্যান্টিক, ক্র্যাফ্টস আর খাবার এর বিকিকিনি। জংকার-এ একটা চমৎকার পাব আছে নাম জিওগ্রাফার্স ক্যাফে, লাইভ মিউজিক থাকায় একটা হাইনিকেন নিয়ে বসে গেলাম, ইত্যবসরে মাশীদ এদোকান সেদোকানে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। Stadhuys Building-এ আরেকটা মিউজিয়াম, রাত নটা পর্যন্ত খোলা থাকে। হাতে সময় থাকায় ঢুঁ মারতে গেলাম। তেমন আকর্ষনীয় এক্সিবিট ছিল না, হুদাই চারটা রিঙ্গিত নষ্ট!

মালাক্কার ইতিহাস একটু বলি এই ফাঁকে। ১৩৭৭ সালে পরমেশ্বরা মালাক্কায় পালিয়ে আসেন সুমাত্রা থেকে। ক্লান্ত পরমেশ্বরা যখন ঘুমাচ্ছিলেন গাছতলায়, তখন দেখতে পান একটা ছোট্ট হরিন (মাউস ডিয়ার) লাথি মেরে একটা তাগড়া কুকুরকে নদীতে ফেলে দেয়। এতে কিছুটা অবাক হন পরমেশ্বরা, ভাবেন এটা হয়তো কোন দৈব নির্দেশনা। তখন সিদ্ধান্ত নেন এই খানেই রাজ্যের সূচনা করবেন। আর যে গাছের নীচে তিনি শায়িত ছিলেন, তার নামে রাজ্যের নাম দেন মালাক্কা। ১৪০০ সালে তিনি একটা বেশ যুৎসই জায়গায় বন্দর স্থাপন করেন যেটা সারাবছর ধরে সুগম থাকায় খুব দ্রুত জনপ্রিয়তা পায়। ১৪১৪ সালে পরমেশ্বরা ইসলাম গ্রহন করে নাম নেন রাজা ইস্কান্দার শাহ। ১৫১১ সালে মালাক্কায় পর্তুগীজরা ঘাঁটি গাড়ে, ১৫২৬এ সুলতান তাদের তাড়া খেয়ে পালিয়ে বাঁচেন। ১৬৪১ ওলন্দাজরা দখলে নেয় মালাক্কার যা টিকে থাকে ১৭৯৫ পর্যন্ত। এর পরে আসে ব্রিটিশরা।

সেন্ট পলস চার্চ, মালাক্কা
সেন্ট পলস চার্চ, মালাক্কা

এপিটাফ, সেন্ট পলস চার্চ, মালাক্কা
এপিটাফ, সেন্ট পলস চার্চ, মালাক্কা

বলা হয়, "Melawat Melaka Bererti Melawati Malaysia" যার অর্থ "মালাক্কা দেখা মানে মালেশিয়া দেখা"! এর সত্যতা নিয়ে আমার হালকা সংশয় থাকলেও মালাক্কা দেখার জন্য মানুষের অভাব হয় না।

হোটেল পুরীতে পাখির বাসা (এর স্যূপ বিখ্যাত)
হোটেল পুরীতে পাখির বাসা (এর স্যূপ বিখ্যাত)

যাই হোক পরদিন সকালে উঠে আমি দৌড় দিলাম ফাইন দিতে আর মাশীদ গেল বাবা-নিয়োনইয়া মিউজিয়ামে। ঝামেলা শেষ হতেই বের হলাম Fort A Famosa দেখতে। ফোর্টের ফটক ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। সেটা দেখে রওনা দিলাম সুলতানের প্রাসাদ দেখতে। কাঠের তৈরি এই প্রাসাদ এখন জাদুঘর। এই জাদুঘরটা বেশ ভালোই ছিল, অন্তত ইতিহাস কিছু জানা গেল । মালেশিয়া বীর হান তুয়া (Hang Tuah) আর হান জেবাত (Hang Jebat) এর গল্প জানতে খারাপ লাগলো না। যাদুঘরে প্রচুর ক্রিস (Kris) বা ছোরার সংগ্রহ ছিল। ক্রিস এর ফলা ঢেউ খেলানো, সাধারনত বিজোড় সংখ্যক ঢেউ থাকে এতে আর এই ঢেউ এর জন্মই ক্রিসকে কার্যকর মানুষ খুন করার অস্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা।


বাবা-নিয়োনইয়া মিউজিয়াম, মালাক্কা

বাবা-নিয়োনইয়া মিউজিয়াম, মালাক্কা

যাদুঘর থেকে বের হয়ে দাতারান পালোয়ানে খেতে গেলাম। ফুডকোর্ট এ সস্তায় খাওয়া যায়। মুস্কিল হল খাবার মুখে রুচবে কিনা। খেয়েদেয়ে বাড়ি পথে রওনা দিলাম, ধান্দা মাঝপথে মেলাকা জু দেখে ফেলা। চিড়িয়াখানা দেখার বুদ্ধিটা বেশী ভালো ছিল না। ঠা ঠা রোদা ক্লান্ত হয়ে কোন মতে পার্কিং লটে ফিরলাম। তারপর ১২০ তুলে ঠাই ঠাই করে বাড়ির পথে রওনা!

মালেশিয়াতে দেখার জায়গা প্রচুর, তবে কম খরচে কম সময়ে ভালো কিছু দেখতে হলে মালাক্কাকে তালিকার শুরু রাখাটা হবে বুদ্ধিমানের কাজ। এই সোমবার সাবা যাচ্ছি। শুনেছি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রেইনফরেস্ট আর বীচগুলোর কিছু আছে সেখানে। দেকা যাক কি হয়। আনটিল দেন...

No comments:

Post a Comment

To comment in Bangla, please use Avro Keyboard Interface. Click here for Bangla Installation Guide.

বাংলায় লিখতে অভ্র কিবোর্ড ব্যবহার করুন. বাংলা ইন্সটলেশন গাইড পাবেন এখানে