মালাক্কা থেকে ফিরেই রিস্কির সাথে দেখা।
"৩ তারিখে কিন্ত সাবা যাচ্ছি, মনে রাইখো" "সাবা? আমার ভিসায় তো বলা ওনলি ফর ওয়েস্ট মালেশিয়া.. সাবায় যাবো কিভাবে?" "ওইখানে গেলেই দিবেনে.. পাসপোর্ট সাথে নিও", বলে রিস্কি ভেন্ডিং মেশিনের দিকে রওনা দেয়।
সাবার অনেক কাহিনী শুনেছি। এর আদ্যোপান্তই আলাদা। মালেশিয়ার মূল ভূ-খন্ডে অবস্থিত নয় এমন দুটি প্রদেশ হল সাবা আর সারাওয়াক। ম্যাপ খুললে দেখবেন সাবা, সারাওয়াক আর ইন্দোনেশিয়া আলাদা একটা দ্বীপের মতো স্থানে অবস্থিত। আবার সাবা, সারাওয়াকের মাঝে লটকে আছে ব্রুনেই। সাবাহ আর সারাওয়াক আসলে আগে ব্রুনেই এরই অংশ ছিল। প্রতিরক্ষাগত কারনে ব্রুনেই এর সুলতান এই প্রদেশ দুটোকে লীজ দেয় আমেরিকান দের। আমেরিকানদের হাত ঘুরে এর শাসক হয় ব্রিটিশরা। মালেশিয়ার জন্মকালে এরা মালে ফেডারেশনে ঢুকে পরে স্বতন্ত্র রাজ্য হিসেবে। মালেশিয়ার অংশ হলেও মালেশিয়ানদের সাবাতে ঢুকতে ভিসা লাগে (যদিও সেটা অন-অ্যারাইভাল)। মালেশিয়া সরকারও সাবার মানুষকে যতোটা সম্ভব খুশি করে চলে।
সাবা আর সারাওয়াক হল এই অঞ্চলের কিছু শ্রেষ্ঠ রেইনফরেস্ট আর ডাইভিং স্পটের জন্য বিখ্যাত। সাবার সান্দাকান দ্বীপ হল ওরাংউটান এর বাসভূমি। সিপাদান বিখ্যাত সী-টার্টল আর অসাধারন মেরিনলাইফ এর জন্য। এসব জানার পর সাবা সম্পর্কে উতসাহী না হয়ে পারা যায় না। উইকএন্ডে গেলাম লাও ইয়াত প্লাজায়। ক্যামেরার জন্য একটা আন্ডারওয়াটার কেসিং আর নতুন দুজোড়া হাইক্যাপাসিটির ব্যাটারী কিনবার খায়েস। ব্যাটারী পাওয়া গেলেও কেসিং পাওয়া গেল না, অর্ডার দিতে হবে, ডেলিভারী কমপক্ষে দু'হপ্তা, আর সবচে বড় কথা হল দাম প্রায় ষোল হাজার টাকার মতো। স্বচ্ছ প্লাস্টিকের একটা কেসিং কেন ৮০০ রিঙ্গিত দাম হবে মাথায় ঢুকলো না। মনের দুঃখে একটা শর্টস কিনে বাড়ি ফিরলাম।
অফিস থেকে বলেছে ভোর ৪টায় লবিতে জমায়েত হতে। লটবহর হাতে নিয়ে যখন পৌছালাম রিস্কি তখন ডজনখানেক কার্লসবার্গ খেয়ে পুরা আউট। আমরা প্লেনে যাব, বাজেট এয়ার লাইন, নাম এয়ার এশিয়া। বাজেট এয়ারলাইন হলে কি হবে, এরা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের স্পনসর।
আমাদের প্লেন KLIA থেকে না উড়ে, ডানা মেলবে LCCT থেকে। LCCT-কে KLIA এর ধারেকাছেও তুলনা করা যায় না। বাজেট এয়ার লাইনে এয়ার হোস্টেসরাও "বাজেট-বিউটি" নিয়ে ঘোরে সেটা জানা ছিল না। এয়ার এশিয়ার হোস্টেসদের পোষাক কিঞ্চিত আপত্তিকর-রকম ছোটখাট হলেও তাদের ভাঙ্গাচোরা চেহারা দেখে উদ্দীপনা দমে যেতে বাধ্য, এবিষয়ে মিনিট পাঁচেকের মধ্যে প্রায় সবাই মতৈক্যে পৌছাল। এদের প্লেনে সীট নাম্বার নেই। প্রায় প্লেনে ওঠার সময় প্রায় সবাই আক্ষরিক অর্থে দৌড়ায়। কোনমতে বসতে পারাই একটা বড় অ্যাচিভমেন্ট!
সাবা পৌছাতে প্রায় দুঘন্টা লাগে। প্লেন থেকে নেমে জানতে পারলাম এই শহরটার নাম কোটা কিনাবালু। এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশনে বরাবরেই মতো আমি আর রিস্কি আটকে গেলাম। ভিসায় পূর্ব মালেশিয়ার কথা নেই, মুখ গম্ভীর করে অফিসার ইতিউতি করেন। সমাধান করলেন বড়কর্তা। ৩০ দিনের প্রবেশাধিকার পাওয়া গেলে অবশেষে।
এয়ারপোর্টে টুর গাইড বাস দিনে রেডী ছিলেন। গাইডের নাম জে, চীনা আর সাবানদের মিক্স! ভীষন রসিক। আমাদের থাকার জন্য ঠিক করা হয়েছে শাংরিলার তান্জুল আরু রিসর্ট। একে ফাইভ স্টার, তারপরে সৈকতের ধারে। ২০০ মার্কিন ডলারের রিসর্টে নিজের পয়সার থাকা সম্ভব না। মনে মনে বললাম, "আহা!"
১১টার দিকে আমরা রওনা দিলাম কিলু নদীর দিকে। সেখান হোয়াইট ওয়াটার ড়্যাফটিং করার ধান্দা! প্রচন্ড আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে কিলু নদীর তীর পৌছাতে ঘাম বের হয়ে গেল।
ল্যাইফভেস্ট আর হেলমেট পড়ে গেলাম ব্রিফিং এ। ১৫ মিনিট পরে আমরা সবাই ড়্যাফ্ট নিয়ে বৈঠা বাইতে শুরু করেছি। কিলু পাহাড়ী নদী, ভীষন খরস্রোতা। ড়্যাফট এ উঠে বিভিন্ন "চীপা"য় পা গুঁজে বসতে হয় যেন না পড়ে যান। স্রোত বেশী হলে ক্যাপসাইজড (ভেলা উল্টে যাওয়া) হবার ভয় থাকে। তাই প্রতি ভেলাতেই একজন দক্ষ গাইড দেওয়া হয়েছে। আমার ফিটনেস কম। একটু বৈঠা মারতেই হাত ব্যথা করে উঠলো। একটু পড়েই ড়্যাফটিং কি কতো প্রকার বোঝা গেল, প্রচন্ড স্রোতে ভেলা লাফ মারে প্রায়, কে জানি ছিটকে পড়েই গেল পানিতে।
বার দুয়েক আমাদের ভেলা পাথরে দড়াম করে ধাক্কা খেল। হঠাত গাইড বলল, সামনে ক্যাপসাইজ হবার সম্ভাবনা আছে। তার কথা প্রায় সত্যি করে ভেলাটা উল্টে যাবে যাবে করেও শেষমেষ টিকে গেল। হাঁপ ছাড়লাম সবাই। ড়্যাফটিং শেষে শুনি বডি ড়্যাফটিং হবে, মানে শরীর দিয়ে ভেসে ভেসেই নদীতে এগুতে হবে। বিষয়টা শুনতে যতো সহজ, কাজটা ততোটা নয়। এবং মানইজ্জতে মাথা খেয়ে আমি পানিতে খাবি খাওয়া শুরু করলাম। সারা শরীর ভাসলেও মুখ একটু পর পর পানিতে ডুবছে, না পারি শ্বাস নিতে, না পারি ভাসতে। মনে হল মরে যাচ্ছি, স্রোত ভেসে চলে যাব দূরে, সব আশা শেষ। সুযোগ পাওয়া মাত্র জবাই করা খাসীর মতো কন্ঠে চিতকার করলাম, "হেল্প, হেল্প, হেল্প!!"
মিনিট পাঁচেক পর গাইড উদ্ধার করে আমাকে। ইত্যবসরে আমার খাবি খাওয়ার ঘটনা পুরোটা ভিডিও করা হয়ে গেছে, মোটামুটি আগামী বছর তিনেক হাসির খোরাক দিতে পারবে সেটা।
দুপুরে খাওয়াদাওয়া হল নদীর কাছেই রিভারবাগের রিসর্টে। যখন হোটেলে ফিরলাম তখন প্রায় সবারই শরীররে বিভিন্ন জায়গায় ছড়ে গেছে আর টনটনে ব্যথা সব জায়গায়। টিমবিল্ডিং মাই ফুট। রাতে ডিরারের পরে দুঘন্টার জন্য ফ্রী ফ্লো শীভাস রিগ্যাল আর কার্লসবার্গ। এর পরের ঘটনা না বলাই ভালো। সকালে উঠে জানলাম রিস্কি পোল ড্যান্সে করে ফাটিয়ে ফেলেছে। আমি ছেলে ভালো। মাতাল হলে ঝামেলা করিনা। তারপরো মনে হল বলি ধরণী দ্বিধা হও।
দ্বিতীয় দিন গেলাম KK Adventure Park এ। গতদিনের ধকল আর হ্যাংওভারের ফলে লাফঝাঁপ নিয়ে কোন আগ্রহ ছিল না। চামে চিকনে শুয়ে বসে পার করলাম। তবে যখন সাগরে কায়াক (নৌকা) চালানোর ডাক এলো তখন কি বসে থাকা যায়। কায়াক চালাতে হাতে জোর লাগে প্রচুর। দশ মিনিটের মাথায় আমি আর চিয়া ওয়েন দুজনেই হাল ছেড়ে দিলাম। এর চেয়ে লাইফ জ্যাকেট পরে ভেসে থাকা অনেক মজার। রাতে ডিনার ভালো ছিল। তবে আবার মাতাল হবার কোন ইচ্ছা ছিল না। ইনাফ ইজ ইনাফ!
তৃতীয় দিনে, স্পীডবোটে করে রওনা দিলাম সাপি দ্বীপে। সবারই গভীর উত্তেজনা, কারন সী ওয়াকিং করা হবে। সী ওয়াকিং আর কিছুই না। মাথায় একটা ৩৫ কেজি্র হেলমেট পরে পানিতে নামতে হয়। পাইপে করে উপর থেকে বাতাস পাঠানো হয়, তাই অক্সিজেন ট্যাংক কাধে নিয়ে বেড়ানোর ঝক্কি নেই।
আট থেকে আটান্ন বছরের সবাই এই কাজটা করতে পারে অবলীলায়, যা স্কুবা ডাইভিং এর ক্ষেত্রে চলে না। সাপি দ্বীপের সৈকতে টুংকু আব্দুল রহমান মেরিন পার্ক। সেখানে হাজারো রকম মাছের আনাগোনা। সী ওয়াকিং এ আমরা সেই সব রঙবেরঙ এর মাছ গুলোই দেখবো।
আমার পালা এলো দ্বিতীয় ব্যাচে। সে এক অসাধারন অভিজ্ঞতা! মাছে মাছে মেলা বসে যায় ফটিক স্বচ্ছ নীল পানিতে। মনে হবে হাটছেন অ্যাটলান্টিসের তলদেশে। ফাইন্ডিং নিমোর সেই ক্লাউন অ্যানেমনফিশ দেখার সুযোগ হল। পোষা মাছের মতো শৈবালে ছুটে বেড়াচ্ছে সে।
সী ওয়াকিং শেষে, বাকিটা সময় কাটালাম স্নরক্লিং করে। এই কাজটা এখন বেশ ভালোই পারি। পানিতে নেমে আমি অবাক! ব্যাট ফীশ, সার্জেন্ট মেজরসহ হাজারো ডেমসেল ফিশ, প্যারট ফীশ আর কোরাল দেখে আমি পাগল! আধাঘন্টা বাদে হঠাত পায়ে কি যেন কামড়ে দিল। আমি পড়ি কি মরি করে ছুটলাম তীরে। কালো ডেমসেল মাছগুলো ডিম পেড়ে পাহারা দিচ্ছিল । আমার পদধূলি পছন্দ না হওয়া কামড়ে দিয়েছে। তীরে এসে দেখি রক্ত বের হয় ভালোই দাগ হয়ে গেছে।
ভীতু মানুষ তাই আর পানিতে নামলাম না। পরে রাও এর কাছ থেকে শুনলাম আরও বিপদের গল্প। পায়ে ক্ষত নিয়ে সে সী-ওয়াকিং এ গিয়েছিল। একটু পরে সে আবিস্কার করে মাছ গুলো রুটির টুকরো বাদ দিয়ে তার ক্ষত কামড়ে যাচ্ছে গভীর আগ্রহে। তাই সাবধানবানী: উন্মুক্ত ক্ষত নিয়ে সাগরে নামবেন না।
জেটিতে নেমেই দেখেছি জেলী ফিশের নোটিশ। রমেশ দাবী করে বসলো তারপায়ে নাকি লেগেছেও একটা। জেলী ফিশের সাথে পরিচিত না হলে বেশ বিতিকিচ্ছিরি ঘটনা ঘটতে পারে। মরন হবে না, কিন্তু জ্বলুনী মারাত্বক!
রাতে কেএল ফেরার আগে সবাই গেল ফিলিপিনো মার্কেটে ঢু মারতে। সাবার শুটকি (ইকান মাসিন) খুবই ভালো। মজার বিষয় হলো, এরা ইলিশের শুটকি খুব পছন্দ করে। দেশের মাছ বলে কথা, তাই দুটো ইলিশ কিনেই ফেললাম।
রাতে এয়ারপোর্ট যেতে যেতে মনে হল আবার আসা দরকার। সেন্দেকানে উরাং উটান সিপাদান দ্বীপের কাছিম না দেখলে চলে না। আরেকটা দেখার জিনিস মাউন্ট কিনাবালু। বলা হয় দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার সর্বোচ্চ পর্বত এটা। মেঘের কারনে এবার দেখাই হল না। নাহ, মাশীদকে নিয়ে আবার আসতেই হবে কোন দিন।