মালেশিয়ায় এসে অনেক নেশায় পেয়ে বসেছে, কিন্তু যেটা ধরার একদমই কথা ছিল না শেষে সেটাই জেঁকে ধরলো। সাঁতার পারি না, তার উপরে ছোটবেলায় Jaws দেখে পানিতে নামার প্রতি কঠিনরকম ফোবিয়া তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ঝামেলাটা বাঁধালো ইন্দ্রনীল, তিওমানে গিয়ে সে আধা ন্যাংটা হয়ে মুখে স্নোরকেল কামড়ে, পায়ে ফ্লিপার পড়ে পুটি মাছের মতো নীল পানি দাবড়ে বেড়াতে শুরু করলো। ঠাঠা রোদে মুখ বাঁকা করে যখন বসে আছি তখন সে জিজ্ঞেস করলো, একটা টেরাই দেব নাকি?
সম্ভবত গরমের কারনেই রাজি হয়ে গেলাম, তারপর মনে হল সাঁতার তো পারি না। নৌকাওয়ালা দাঁত বের করে জানালো লাইফভেস্ট পড়ে স্নোরকেলিং করা আরো সহজ।
কোমর পর্যন্ত ডুবতেই শরীর ঠান্ডা হয়ে এলো, এক হাতে শক্ত করে সেফটি লাইন ধরা আরেক হাতে লোহার সিড়ির হ্যান্ডেল। পুরো ডুবতে সাহস হয়না, মাথার মধ্যে ঘুরছে পাখনা তুলে ছুটে আসার হাঙরের ছবি! তারপর কি মনে করে নেমেই পড়লাম। যা হবার তাই, নাকে মুখে পানি ঢুকে একাকার, স্নোরকেলিং করা খুব কঠিন না, কিন্তু হিসাব নিকাশ ভুলে গেলে প্রচুর লোনাজল গিলতে হয়!!!
তারপর... হু.. আধাঘন্টা পড়ে দেখা গেল, আমি ব্যাঙের মতো হাতপা ছড়িয়ে ফটিকস্বচ্ছ সাগরজলে ভেসে আছি! জীবনে অনেকদিন পর সেবার ভয়ংকর রকম অবাক হলাম! জলের দুনিয়ায় এতো রঙ!!! এতো বৈচিত্র্য!! সেই থেকে শুরু..
পায়ার দ্বীপে যখন গেলাম, ততোদিনে ভয়ডর সবগেছে, এবং সেবারই হাঙর ছানাদের বেশ কাছ থেকে দেখা হল! লোকজনকে ঘাড় দুলিয়ে গল্প করি, সবাই মনোযোগ দিয়ে শোনে, তারপর জানতে চায় পায়ার দ্বীপ কি রেদাং থেকেও সুন্দর কিনা। রেদাং রেদাং শুনতে শুনতে শেষে বিরক্ত হয়ে গেলাম।
মালেশিয়ার শ্রেষ্ঠ ডাইভিং পয়েন্টগুলো পড়েছে পূর্ব মালেশিয়াতে। সিপাদান আর লায়াঙ লায়াঙ দ্বীপের স্বচ্ছপানি আর জীববৈচিত্র্যের সুনাম দুনিয়াব্যপী। আর যারা ওদিকে যেতে পারেন না তাদের প্রিয় তালিকায় থাকে রেদাং, তিওমান আর পেরেন্থিয়ান দ্বীপ। তিওমানে আগেই গেছি। রেদাং আর যাওয়া হয়নি, তাতে যতোনা আক্ষেপ ছিল তার চেয়ে বেশী বিরক্তি যোগ হল লোকজন কচকচানি শুনে!
এখানে লঙ উইকএন্ডে কেউ ঘরে থাকেনা, ওসব সময় হোটেল পাওয়া বিশেষ কঠিন হয়ে পড়ে। মারদেকার ছুটিতে এসব জেনেও এম্নি এম্নি ফোন করা শুরু করলাম এবং দুরাশার পাছায় কষে থাতি মেরে আমি কেমন করে যেন রেদাং প্লাঙ্গি রিসোর্টে একটা রুম পেয়ে গেলাম। মাশীদ কেবল মিটিং থেকে ফিরছিল, বললাম রাত্তিতে রেদাং যাচ্ছি, রেডি হও।
"রাত্তিরে রেদাং যাচ্ছি" বলাটা যতো সহজ কাজটা ততোটাই কঠিন। কেএল থেকে সাড়ে ছয়শো কিলো পাড়ি দিয়ে যেতে হবে ত্রেঙ্গানু রাজ্যে, সেখান থেকে ফেরিতে চল্লিশ মিনিট পারি দিলে নীলজলসোনাবালির দ্বীপ! মেরাং এ পৌছাতে হবে সাতটায়। তার অর্থ হল আমাকে টানা ৬ ঘন্টা ড্রাইভ করতে হবে এবং সেটা নরমাল স্পীডলিমিটের উপরে। কাজটা ভয়াবহ কঠিন হতো যদি না পাহাঙ রাজ্যে নতুন এক্সপ্রেসওয়ে না বানাতো। ১৪০-এ আমার প্রোটন স্যাভি ঠিক ঠিক ৬টায় পৌছে গেল মেরাং জেটিতে। এখানে জিপিএসের ম্যাপগুলো ভালো, না হলে ভালো ঠ্যালায় পড়ার সুযোগ থেকেই যায়।
গাড়ি থেকে নেমে দেখে দুহাত ঝিমঝিম করছে। পেটেও ক্ষুধা। মালেশিয়ার সবচে' নিরাপদ খাবার হল নাসি লেমাক। সাদা ভাত, সাথে শুকনা মরিচ, টমেটো, পেয়াজের ঝাল-মিস্টি ঝোল, তাতে ছড়িয়ে দেওয়া কড়া করে ভাজা অ্যানচোভি আর চীনেবাদাম, সঙ্গে আধাটা সেদ্ধ ডিম, কপাল ভালো হলে এক টুকরো ভাজা মুরগি - এটা এদের জাতীয় খাবার সম্ভবত, আর ভাতের প্রতি ব্যপক ভালোবাসার কারনে ফেভারিট! বহুদিন পর ভোরবেলা নাসি লেমাক আর চা দিয়ে নাস্তা করতে ভালো লাগলো, আহা! কতো দিন সকালে উঠে ঢাকার মতো চা খাওয়া হয়না! (মাশীদ অবশ্য এখন প্রতিরাতে এককাপ বানিয়ে দেয়, মেয়েটার বড়ই মমতা!)
চা-নাস্তা করে দাঁড়ালাম ফেরীর অপেক্ষায়। সাথে দুটো ক্যামেরা, আমার দাঁড়ানোর ভঙ্গিই আলাদা সেই উত্তাপে! হঠাৎ মাশীদের খোঁচা, "ওইটা কি?" নৌকার নীচে সেই প্রথম আমাদের বাচ্চা অক্টোপাস দর্শন!! এর আগে তিওমান গিয়ে উরুক্কু মাছ দেখে বাকহারা হয়েছিলাম, এবার অবাক হওয়া আটপেয়ে এই জীবটাকে দেখে!
ফেরীতে রেদাং পৌছাতে এগারোটা বেজে গেল। একদম সেই ছবির মতো নীলার মতো হালকা নীল জল, আর সোনালী সৈকত, তারমাঝে ছোটবড় সবুজ পাহাড়ের রাজত্ব!
দুইরাত তিনদিনের প্যাকেজ, জনপ্রতি সাড়ে চারশো রিঙ্গিত। "রেদাঙ প্লাঙ্গি" মোটেও সুবিধার রিসোর্ট না, চলেটাইপ ঘর, বিচ্ছিরি খাবার আর সাদামাটা আয়োজন (যারা রেদাঙ যাবেন তারা চেষ্টা করবেন লাগুনা রিসোর্টে যেতে, লাগুনা হল "সেইরকম" জায়গা!) । তবে একটা জিনিসের জন্য আমি এদের সাতখুন মাফ করে দিলাম, নেমেই দেখি আন্ডারওয়াটার ক্যামের ভাড়া দিচ্ছে, ৫০ রিঙ্গিতে ১৫০ ছবি তোলার ব্যবস্থা করা! আমাকে আর পায় কে!
মালপত্র রেখে যখন হালকা হবো ভাবছি তখন লোকজন ডাকাডাকি শুরু করলো, ১ম স্নোরকেলিং ট্রিপ শুরু হবে একটু পড়েই! মাস্ক আর স্নোরকেল পেলাম, কিন্তু ফ্লিপার মিসিং! খোলা সাগরে ফ্লিপার ছাড়া নড়াচড়া করা মহা ঝামেলার। গিয়ে শুনি রেদাঙ দ্বীপে ফ্লিপার পরে সাঁতারানো নিষেধ!
পানিতে নেমে কিছুটা আশাহত হতে হল, প্রবালগুলো ভাঙ্গা, মাছের বৈচিত্র্য কম। খুব বেশী টুরিস্ট আশার ফল! পুলাও পায়ারে গুনে গুনে লোক নেয় প্রতিদিন, তাই সৌন্দর্য এখনও অক্ষত। টাকার লোভে রেদাঙ এর বেহাল দশা! ফ্লিপার ছাড়া সাঁতারাতে অনেক বেশী কষ্ট করতে হচ্ছিল, পানিতে স্রোত ভালোই, একটু বেশী সতর্ক হয়েই থাকতে হয়। যখন পানি থেকে বোটে উঠলাম তখন দু'হাত ব্যথায় অবশ!
দুপুরে রিসোর্টে বুফে লাঞ্চের কথা। খাবার দেখে মেজাজ খারাপ, তার উপরে চীনেরা মাগনা পেয়ে খাবার প্রায় সব শেষ করে দিয়েছে। বেশী খাওয়া আর হল না, কারন দুটোর সময় ২য় স্নোরকেলিং ট্রিপ আছে।
মাশীদের মাস্ক পরে পানিতে মাছ দেখার আগ্রহ কোনকালেই ছিল না, সে থেকে গেল দ্বীপে। আমাদের আনা হল পাথর ঘেরা একটা জায়গায়, বেশ সুন্দর, নানা রকম প্রবালে ভরা। গভীর আগ্রহে তাই পানিতে নেমে গেলাম। এবং তারপরই বিপত্তি। প্রচন্ড ভয়ে আমরা হাতপা ঠান্ডা হয়ে গেল। মুখ দিয়ে কেমন করে শ্বাস নিতে হয় ভুলে গেলাম, লোনা পানি পেটে-চোখে গিয়ে একাকার। না, হাঙর না। এ জিনিস আরও ভয়াবহ...
জেলীফিশ! ডজনে ডজনে চারপাশ জুড়ে। ছাগলগুলো জানায়নি এটা জেলীফিশ সিজন!
হাতে পায়ে কাটা ছেড়া থাকলে হাঙর কেন, পিচকি মাছও হিংস্র হয়ে কামড়াতে আসে। এম্নিতে তারা ঝামেলায় যায় না। অন্যদিকে জেলীফিশের ঘিলু নাই। সেই উদভ্রান্তের মতো পানিতে ভেসে বেড়ায়। তার কাছ থেকে দূরে থাকার দায়িত্ব আপনার, তার গুতো খাবার ভাবনা নেই। আর একবার যদি গায়ে লাগে, তখন নাকি ভয়ংকর ভাবে জ্বলেপুড়ে যাবার অনুভূতি হয়। মিনিট পনেরো সময় লাগলো পরিস্থিতে স্বাভাবিক হতে। একটু করে ছবি তুলি, তারপর কিছুক্ষন নজরদারী করি মামারা কোথায়। দু'পা খোলা, ঘষা লাগলে মহা গ্যাঞ্জাম! লোক বলে জেলীফিশ ছুঁয়ে দিলে সেরা ঔষধ হিসি করে দেওয়া। কিন্তু কেউ পানির মধ্যে নিজের পায়ের উপর হিসি করার তরিকাটা বলেনি। টোটকা ঔষধের এই সমস্যা!
দ্বীপে ফেরার পর আমার চোখ গাঁজারুদের মতো লাল। ঠিক করলাম ডিনার করবো ভালো কোথাও। একটু হাটতেই সামনে পড়ল লাগুনা রিসোর্ট। সৈকতে চমৎকার বার দেখে মার্গারিটা খাবার সুযোগ ছাড়লাম না। রাতে সেখানেও গিটার বাজিয়ে গান শোনালো লোকজন। সুস্বাদু একটা গার্লিক স্টেক গিলে, গান শুনলাম কিছুক্ষন। তারপর অনেকটা সময় নিয়ে ডেকচেয়ারে শুয়ে বাতাস খেতে খেতে তারা গুনলাম দুজনে। এরকম জায়গায় দল বেঁধে গেলে খুব জমে ওঠে, বিশেষতঃ সৈকতে শুয়ে পানপর্ব চালানোর চেয়ে ভালো কি আর হতে পারে...
রাত একটার দিকে রুমের দিকে হাটা দিলাম। হাটতে হচ্ছিল সাবধানে, সৈকত জুড়ে মরা জেলীফিশ, রাতবিরেতে পা দিয়ে অঘটন ঘটনার কি দরকার!
রেদাঙ এ এর পরে আরো একটা দিন ছিলাম। আরো চমৎকার একটা স্নোরকেলিং পয়েন্টে নিয়ে গিয়েছিল ওরা। খারাপ ছিল না। কিন্তু মাছের বৈচিত্র্যহীনতায় হতাশ হতে হয়েছে। পায়ার দ্বীপ আর সাবা-র টুংকু আবদুল রাজাক মেরিন পার্কের মতো মুগ্ধ হওয়া গেল না এবার। মনে হল রেদাঙ তার সৌন্দর্য হারিয়ে একটা ওভাররেটেড অবস্থানে বসে আছে। টাকা থাকলে সিপাদানে যেতাম। কিন্তু যা খরচা হবে তাতে একটা DSLR কিনে ফেলা যায়! তাই প্ল্যান বাদ দিতে হল।
সময় হলে আবার একবার তিওমানে দ্বীপে যাব। যারা উৎসাহী তারা মাথায় রাখবেন এখানে দ্বীপগুলোতে যাবার সেরা সময় মার্চ থেকে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ। বাকিটা সময় মনসুন পিরিয়ড বলে দ্বীপগুলোতে টুরিস্টদের যেতে দেওয়া হয়না।
এই দেশটায় থাকার সময় দিন দিন ফুরিয়ে আসছে, কতো কিছুই না দেখা থেকে গেল...!