ভদ্রলোকের নামটা অনেক কষ্ট করেও মনে করতে পারলাম না। ঢাকার মহামালদার এক পাবলিকের আইটি ম্যাগাজিন করার খায়েস হয়েছিল। বছর খানেক পর সেই পত্রিকা যখন ধরা খায় খায় তখন এক ধান্দাল যুবকের কল্যানে আমি কারিগরি সম্পাদকের চাকরীটা পাই। আর ভদ্রলোক যোগ দেন নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে।
একদিন দুপুরের খাবার খেয়ে একটা বাংলা ফাইভ ধরানোর তাল করছি, ভদ্রলোক গলা যথা সম্ভব নামিয়ে বললেন, "করিম ভাই (এটা আসল নাম নয়) নাকি জামাত করতেন?"
আমি হালকা ধাক্কা খাই, গুজবটা আমারো শোনা, কিন্তু বিশ্বাস করার মতো হিন্ট পাইনি তখনও। সেই গুজব যখন ঝানু সাংবাদিকের মুখেও শুনতে হয় তখন একটু চিন্তাই হয়।
"উনাকে ছাগলা দাড়ি সহ মজলিশে সভা করছেন চিন্তা করতে আমার কিন্তু একটু কষ্ট হয়...", আমি বলি।
এর পরে প্রায়ই ভদ্রলোকের সাথে কথা হতো, রাজনীতি, ধর্ম, সমাজ এবং জনৈক করিম ভাইকে নিয়ে। অনেক কথার ফাঁকে ভদ্রলোক খুব শান্ত ভঙ্গিতে আমাকে একদিন বললেন, "দেশটা ইরান হয়ে যাবে", তারপর আরও শান্ত ভঙ্গিতে "পাঠকের চিঠি" লেখা চালিয়ে যেতে লাগলেন (পত্রিকায় পাঠকেরা কোন চিঠি দিতো না বলে আমরাই বসে বসে চিঠি পয়দা করতাম)। ঠিক মনে নেই এটা শোনার পর আমি কি বলেছিলাম সেইদিন। মাস খানেক পর চাকরী ছেড়ে দিলাম। কিন্তু ভিতর থেকে প্রায়ই কে যেন শান্তগলায় বলে উঠতো, "দেশটা ইরান হয়ে যাবে"।
এরপর আরো পানি গড়ায়, আরো বসন্ত যায় আর আমি লোকজনকে পেলেই জিজ্ঞাসা করি, "দেশটা কি ইরান হয়ে যাবে?", কেউই আমাকে দুই পয়সার পাত্তা দেননি, চেনা উত্তর ছিল, "মৌলবাদীদের নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নাই"..
আজ ছয় বছর পরেও কথাগুলো কানে বাজে। এই আশংকার আদৌ কি কোন সম্ভাবনা আছে? মৌলবাদীরা কি এতোই শক্তপোক্তভাবে শেকড় গাড়তে পারে?
তারপর..
টের পাই এদের কি দরকার যদি এই দেশে ভ্রষ্ট আর বিভ্রান্ত একটা প্রজন্ম তৈরি হয় যারা বিয়ার হাতে ধর্মানুভূতির বিতন্ডায় ঝাঁপ দেবে...!
এদের কি দরকার যদি আমার দোতলার হাজি সাহেব হজ্জ্ব থেকে ফিরে ট্যাক্স ফাঁকি দেবার ধান্দা নিয়ে বসেন?
এদের কি দরকার যদি সেরা বিদ্যাপীঠের প্রবীন শিক্ষক ছানিকাটা চোখে জমজমের পানি দিয়ে ইনফেকশনে পড়েন?
এদের কি দরকার যখন আমার অশ্লীল-হিন্দী-নাচ-দেখা বন্ধুটা বউকে পর্দা করতে বলে?
এদের কি দরকার যখন খাটি "বাংলা নাম" রাখাটা কেমন হিন্দুয়ানী শোনায়?
আমরা সবাই যদি অন্ধকারে ঝাঁপ দেবার খেলায় জমায়েত হতে থাকি, তাহলে কি আর ধর্মবিপ্লব লাগে?
তাই ঠান্ডা মাথায় বসে থাকা অভ্যাস করি
কবে অপরাজেয় বাংলার মাথা কাটা যায়,
কবে স্মৃতিসৌধ গুড়িয়ে দিয়ে
জাতীয় মিনার হয়,
কবেই বা "পাখি সব করে রব" বদলে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান তরিকায় "ফজর হইল, মোরগ ডাকিল" লেখা হয় শিশুপাঠে..
আমি বসে আছি, শান্ত ভঙ্গিতে শুনবার জন্য এই খবরগুলো..
আমি খুব জানি, একদিন সবই গা-সহা হয়ে যাবে,
চাট্টান দিল নিয়ে আমাদের সন্তানেরা পূর্বপুরুষের কৃতকর্মের জন্য একফোঁটাও অনুশোচনা করতে বসবে না..
আহা, বোধহীণ হতে পারলেই কতোই না শান্তি!..
----------------------
১৯শে অক্টোবার, ২০০৮
কেএল ফোটোগ্রাফি ফেস্টিভ্যাল ২০০৮
আলোকচিত্রী ভিক্টর চিন দেখাচ্ছিলেন থাইল্যান্ডের Ayutthaya নগরীতে, বর্মীদের হাতে মাথা কাটা যাবার পর টিকে থাকা বুদ্ধমুর্তিগুলো...